[৭ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ] :
প্রথমত ছিল মার্কিনবিরোধী অবস্থানে থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো, দ্বিতীয়ত রয়েছে- চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টকনাফ দিয়ে রাখাইন পর্যন্ত করিডোর পাওয়ার মিশন। এটি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের জন্য তৈরি করা 'ম্যাটিক্যুলাস প্লান’। এখন দ্বিতীয় পর্বে শুধু করিডোরই নয়, এরসঙ্গে যুক্ত আছে চট্টগ্রামের সবকটি সমুদ্র বন্দর কব্জা করার টার্গেটও। বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫৪ বছরে যে কাজটি করা সম্ভব হয়নি, এখন নোবেলপ্রাপ্ত ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়ে সেই কাজটি করিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
ঘটনা এরইমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যেমন গত এপ্রিলের ৩০ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ডাকা হয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ- বেজা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের। উচ্চ পর্যায়ের সেই বৈঠকে ড. ইউনূস তার অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে বন্দর ব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরেছেন এবং এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, সরকার এরইমধ্যে চট্টগাম বন্দর ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি নির্দেশ দেন, বন্দরগুলো বিদেশিরা পরিচালনা করবে, এরজন্য সবাইকে যা কিছু করা দরকার করতে হবে। ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের বন্দরগুলোকে আর্ন্তজাতিক বাজারগুলোতে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতায় নিয়ে আসতে হবে, সে কারণে বন্দরগুলো বিশ্বমানের হতে হবে। একমাত্র বিদেশিরাই এটা করে দিতে পারে। সে কারণে এগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তাদের কাছে বাংলাদেশকে ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে।
যেটা জানা গেছে সেটা হলো, 'বিদেশি’ বলতে যে গোষ্ঠীর হাতে বন্দরগুলো তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে- সেটি হলো মার্কিন নৌবাহিনীর নিরাপত্তা সহযোগী প্রতিষ্ঠান 'ডিপি ওয়ার্ল্ড’। দুবাই থেকে এটি বিশ্বব্যাপী মার্কিন নৌবাহিনীর বন্দর পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে থাকে।
এরইমধ্যে ডিপি ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর কর্তৃত্ব নেওয়ার যাবতীয় পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছে। তারা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের পাশে নতুন একটি ফ্রি ট্রেড জোন করার কথাও বলেছে। এই জোনটি হবে ইউক্রেনের কাছাকাছি মালদোভা, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বে মারমারা সমুদ্রের ধারে করা মার্কিন নৌবাহিনীর জেলেবাড়ি পোর্ট ঘাঁটির মত। যেখানে মার্কিন সপ্তম নৌবহরসহ অত্যাধুনি সামরিক ব্যবস্থাপনা, স্যাটেলাইট ও পারমানবিক প্রযুক্তি ব্যবস্থাপণা, ক্ষেপণান্ত্র প্রযুক্তি ব্যবহারের সবকিছু থাকবে। এক কথায় ফ্রি ট্রেড জোনের নামে এই নৌঘাটিতে এমন সব সমরাস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তোলা হবে, যাতে করে ইন্দো-প্যাসেফিক ট্রাটেজি অনুযায়ী চীনকে মোকাবেলাসহ এ অঞ্চলের মাথা উঁচু করতে চাওয়া অন্যান্য সব শক্তিধর দেশগুলোকে পদানত করা সম্ভব হয়।
সুতরাং বলার অপেক্ষাই রাখে না- কী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মার্কিন পরাশক্তিকে জায়গা করে দেওয়ার উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর, মোংলা সমুদ্র বন্দর, পায়রা সমুদ্র বন্দর, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, মিরেরসরাই সমুদ্র বন্দর, সোনাদিয়া সমুদ্র বন্দরসহ বঙ্গোপসাগর এলাকার সবকটি সমুদ্র বন্দর চলে যাবে বিদেশি, অর্থাৎ দুবাইভিত্তিক মার্কিন নৌবাহিনীর নিরাপত্তা সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে। বন্দরগুলো তারা কব্জা করে বা লীজ নিয়ে নিজেদের সামরিক ট্রাটেজি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।
কথা হলো- এতেগুলো কর্মযজ্ঞ সাদাচোখে দেখলে মনে হয়, সাধারণ ব্যাপার। করতে চাইলেই করে ফেলা যাবে। আদতে কিন্তু তা নয়। অন্যসব শক্তিকে টেক্কা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একাই সব কান্ড করে যাবে- আর অন্যরা বসে বসে তা দেখবে- এমন হতেই পারে না। চীনের বিরুদ্ধে এতোবড় ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হবে, আর চীন চুপ করে থাকবে? কখনই নয়। এখন তো চীন শুধু দেখছে, কিন্তু কিছু বলছে না। হয়তো বলবে সময় মত। আর রাশিয়া? গত এপ্রিলের শেষে তাদের অত্যাধুনিক তিনটি যুদ্ধ জাহাজ রেজিক, হিরো অব দ্যা রাশিয়ান ফেডারেশন আলদার সিডেনঝপভ ও পেচেঙ্গা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে চারদিন অবস্থান নিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে গেছে।
আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত? তাদের তো বিপদ এবং মাথাব্যাথা সবচেয়ে বেশি। তারা কী হাত গুটিয়ে থাকবে? থাকবে না। এমনকি মিয়ানমার সামরিক জান্তাও বসে থাকবে না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য কী পরিণতি ধেয়ে আসছে- তা চিন্তা করলে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।
আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই- বাংলাদেশ এমনিতেই এখন ভয়াবহ বিপর্যয় ও সংকটের ভেতর দিয়ে চলছে। দেশে কোন আইন নেই, শৃঙ্খলা নেই। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, ডাকাত, লুটপাটকারী, দখলবাজ, ভূমিদস্যু এবং মানুষ হত্যাকারীদের দোর্দন্ড প্রতাপে মানুষ পুরো দিশেহারা। রাতে চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে। নারীদের জীবনযাত্রা চরম হুমকিতে। প্রতিদিন অগণিত মানুষ খুন হচ্ছেন, আহত হচ্ছেন, নারী ও শিশুরা ধর্ষিত হচ্ছেন। কোন বিচার নেই। তার বদলে উশৃঙ্খল তরুণদের মব-জাস্টিসে সর্বস্তরে চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, জবরদস্তিতে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ। মগের মুলুকে পরিণত হয়েছে পবিত্র এই ভূমি। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের কোন পদক্ষেপ নেই। এ নিয়ে কোন রকম ভাবনা-চিন্তা করার সময় নেই তাদের। তারা ব্যস্ত বিদেশি শক্তিকে খুঁশী করে টিকে থাকার পথ তৈরিতে।
এদিকে, দেশে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রয়োজন। এরজন্য প্রয়োজন নির্বাচন। কিন্তু সরকার সেটা দিতে নারাজ। তারা ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নয়। বরং তাদের একটাই ভাবনা- কীভাবে আজীবন ক্ষমতায় থাকা যায়। এর জন্য তারা হেন কাজ নেই, যা তারা করতে দ্বিধাগ্রস্ত। সুতরাং তাদের এই অবস্থান বুঝে বিদেশি অপশক্তিগুলো এদেশে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা, জাতিসংঘের কর্মকর্তা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্মকর্তাদের পদচারণায় প্রতিদিনই ব্যস্ত থাকছে রাজধানী। এদেশ এখন তাদের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই তারা দলবল নিয়ে আসছেন এবং নানা ছক কষে যাচ্ছেন। অথচ কেউ বাংলাদেশের জন্য কোন অর্থনৈতিক সহায়তা, বাণিজ্য সহায়তা কিংবা ঋণ সহায়তায় অগ্রসর হচ্ছে না। মুখে নানা আশ্বাস দিচ্ছে বটে, কিন্তু কাজে কর্মে করছে উল্টোটা। কারণ তারা জানে, এখন বাংলাদেশে কোন বৈধ সরকার নেই। যেটা আছে সেটা অনির্বাচিত অসাংবিধানিক সরকার। এদের পায়ের তলায় মাটি নেই, কিন্তু ক্ষমতা ধরে রেখেছে। যতোদিন তারা এভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে, ততোদিনের মধ্যে বিদেশি শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সবকিছু হাসিল করে নিতে চাইছে। আর সরকার টিকে থাকার স্বার্থে তাদেরকে সবই উজার করে দিতে চাইছে।