বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১

স্বপ্ন রাতের তারা, আশির দশকের ধরাবাহিক গল্প (পর্ব- ৩)

 

স্বপ্ন রাতের তারা

-        আবুল হোসেন খোকন

 চার.

বিনুর এক চিঠি পেয়ে গোটা পরিকল্পনাটা ওলট-পালট হয়ে গেল পরিকল্পনা ছিল আসছে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আপার বাড়ি যাবো এটা জানানোও হয়েছিল তারপরেই ঘটনা

এক মাস পরের ব্যাপার বিনু চিঠি লিখেছে তাতে বলা হয়েছে, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আমি ওদের কাছে যাই- তাতে ওর আপত্তি নেই কিন্তু আসল ছুটি নিতে হবে ঈদুল আজহায় কারণ ওই সময় এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে।। বিনু লিখেছে, ‘ঈদুল ফিতরে আমি সঙ্গ দিতে পারবো না কারণ একমাস পর পরীক্ষার জন্য পড়ায় ব্যস্ত থাকতে হবে আপনি আসবেন, সবাই আনন্দ করবে, আর আমি করবো না- তা হতে পারে না আমার কথা হলো, আপনি আসল ছুটি নিয়ে আসবেন ঈদুল আজহায় তখন পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে দারুণ মজা হবে

চিঠির খামে আরও দুটো চিঠি ছিল ওগুলো আপা বুনুর দুজনেই ঈদুল ফিতরে যেতে বলেছে কিন্তু বিনুর যেখানে আপত্তি, সেখানে করার কিছু নেই আবার নতুন করে পরিকল্পনা করা হলো এবার টার্গেট ঈদুল আজহা তার আগে যাবো কণা খালার বাড়ি দেখা হবে বন্ধুদের সঙ্গে তারা সবাই পাবনায় সুতরাং ঈদুল ফিতরের টার্গেট পাবনা পরিকল্পনাটা চূড়ান্ত করে জানিয়ে দিলাম আপার বাড়ি লিখলাম, ‘ ঈদে যাচ্ছি না, সামনের ঈদে যাবো

পরিকল্পনা মতো খালার বাড়ি যেতে এখনও আড়াই মাস বাকি কোন একটা যায়গায় গেলে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়, দেখা যায় অনেক কিছু, জানা যায় নতুন সব ঘটনা আর পাবনায় তো নতুনের ছড়াছড়ি সেখানে আছে অনেক অনেক রোমাঞ্চকর ব্যাপার, আছে বড় এক ইতিহাস এতোদিন পর কি দেখবো সেখানে, জানা নেই অজানা রহস্যের কুন্ডলিকে সামনে রেখে এগুতে হবে এখন শুধু অপেক্ষার পালা এই আড়াইটা মাস এক অসহ্য টেনশনে কাটাতে হবে

 

পাঁচ.

সময়কে ঠেকানো যায় না যতো কঠিনই হোক তা কেটে যায় আড়াইটা মাসও ঠিক কেটে গেল তেমনই অবশ্য কেটে গেল বলা যাবে না, যাবার পথে কারণ এখনও সপ্তাহখানেক সময় বাকি এই দিনগুলো কেটে গেলে রওনা হবার পালা

গত আড়াইটা মাস জটিল সব গিট ছাড়াতে হয়েছে অফিসে কাজ গোছানো, মেসের খুঁটিনাটি সমস্যা সামলানো, চিঠি-পত্র লেখা, ঈদ এবং টাগের্টে যাওয়া উপলক্ষ্যে কেনা-কাটাসহ অন্যান্য টুকিটাকি কাজ শেষ হয়েছে এখন যেটা বাকি আছে সেটা হলো- যে দিন ছুটিতে থাকবো, সে কয়দিনের অতিরিক্ত কাজ করে রাখা নিজের দুচারটে অল্প প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করতে হবে সাতদিন যথেষ্ট সময় সব হয়ে যাবে

হঠাৎ বিনুদের চিঠি এলো এই আসাটা আরও আগেই উচিৎ ছিল অপেক্ষায় অপেক্ষায় ছিলাম আসছিল না দেখে একটা অস্থিরতাও চেপে বসেছিল ঠিক শেষ মুহূর্তে সে চিঠি এলো দুটো চিঠি বিনুরটা পড়তে গিয়েই ধাক্কা খেতে হলো লিখেছে, ‘আজ একটা ক্ষোভ নিয়েই আপনার কাছে লিখছিআমার কাছে বিনু লিখেছে ক্ষোভ প্রকাশ করে! এটা স্বপ্নেও ভাবা যায় না টেনশন বেড়ে গেল কিন্তু না, পরের লাইনগুলো পড়ে ব্যাপারটা পরিস্কার হলো বিনু লিখেছে, ‘ক্ষোভটা আপনার উপর নয়, বরং অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে আমার যখনই খুব কষ্ট হয়, আমি সবার কাছে লিখতে বসি যেদিন ১৪ তারিখ ছিল সেদিন তিনজনকে লিখেছি ১৪ই ফেব্রুয়ারি আমাদের সবার জন্য একটি দুঃসংবাদ বয়ে এনেছিল পেপারে জানতে পারলাম দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে ঢাকাগামী সকাল-সন্ধ্যা বাসে ১০/১২ জন শিবির কর্মী কুপিয়ে হত্যা করেছে আমাদের অপর্ণাদি ছেলের নামও রূপম আমি আর আম্মু দ্রুত মেসে গেলাম বন্ধ তারপর গেলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেখানে তার সঙ্গী জামিলুর রহমান বাবু কাছেই জানতে পারলাম, তিনিই রূপম সত্য নিষ্ঠুর হলেও বাস্তব এই মাত্র সপ্তাহখানেক আগে উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল অথচ তিনিই আজ আর নেই, ভাবতেই কেমন লাগছে যতোবার ভুলবার চেষ্টা করছি, ততো বেশী মনে পড়ছে অপর্ণাদি একমাত্র ছেলে তার কতো আশা-ভরসা বড় বড় নেতা-নেত্রীরা অনেক ভাষণ দিচ্ছেন, কিন্তু বেচারা দিদি পরিবারটাই ভেঙে গেল এখন সবার কথা বাদ দিয়ে তার মুখটাই যেন আগে ভেসে উঠছে আমার বারবার মনে হচ্ছে, উনি যেন আমাদের জিজ্ঞাসা করছেন- কেন এমন হলো? অনেক চেষ্টা করেছি, উত্তর খুঁজে পাইনি

চিঠিটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল রূপম ছিল বড় ভাল ছেলে দেখতে সুন্দর, অমায়িক ভদ্র এবং মেধাবী ছাত্র ছিল সে তার সঙ্গে কারও কোন শত্রুতা ছিল না এমনকি যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের সঙ্গেও না একটা সুন্দর সমাজ গড়তে চেষ্টা করেছে- এমন একটা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ওঠা-বসা করতো রূপম বাবা-মা একমাত্র সন্তান অনেক আশা আর স্বপ্ন ছিল ওর পরিবারে

সেদিন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার এর একদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের সিট ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিল দুটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে গোলাগুলি করার সময় মারাও গিয়েছিল দুজন এরসঙ্গে রূপম বা রূপম যাদের সঙ্গে বেড়ায়- তাদের কারও সম্পর্ক ছিল না যারা রূপমকে হত্যা করেছে, তারা অন্ততঃ ছাত্র-ছাত্রীকে কুপিয়ে, হাত-পায়ের রগ কেটে, গুলি করে আহত করেছে নিজেরাও আহত হয়েছে তারা বোমা, আগুন আর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের শতাধিক কক্ষ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল কক্ষগুলোর কোন অপরাধ ছিল না, অপরাধ ছিল না আসবাবপত্রের জ্বালানোর আগে টাকা-পয়সা-কাপড়-চোপড় লুট করা হয়েছেনারায়ে তাকবিরধ্বনি দিয়ে কোন্ পৈশাচিকতার রাজনীতি কে বলবে? কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে তার আগে দ্রুত হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বাধ্য হয়ে রূপম সন্ধ্যারাতে জামা-কাপড় গুছিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য রওনা হয়েছিল কিন্তু পথেনারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবারধ্বনি দিয়ে বাস থামিয়েছিল একদল ধারালো আগ্নেয়াস্ত্রধারী তরুণ তারা যাত্রীদের টেকে হিঁচড়ে নামিয়েছিল গালি-গালাজ, পিটুনি আর তরবারির খোঁচায় ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল অনেককে যাত্রীদের ভেতর থেকে ছাত্র রূপম আর বাবুকে আলাদা করা হয় কারণ এরা দুজন তাদের দলের সমর্থক নয় শুরু হয় রূপমের হাত-পায়ের রগ কাটা আর অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করার পালা বিভৎস এই পরিস্থিতিতে কোন কাকুতি-মিনতি শোনেনি হত্যাকারীরা আঘাতে আঘাতে রূপম ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল রক্তাক্ত বাবু লুটিয়ে পড়ে ছিল ওরা ভেবেছিল মারা গেছে মানুষ কি কখনও হিংস্র নেকড়ে হতে পারে? হতে পারে পশু? কোন মানুষ কি এভাবে আরেক মানুষকে হত্যা করতে পারে? কেবল পশুরাই তা পারে

মানুষও পশু হতে পারে ইতিহাসও তা বলে, বিজ্ঞানও তা বলে প্রাণী মাত্রেরই মস্তিষ্ক আছে মানুষেরও আছে মানুষের মস্তিষ্কে দুটো ভাগ আছে, পশুর তা নেই মানুষের মস্তিষ্কের একদিকে আছে মানুষ, আরেকদিকে আছে পশু অর্থাৎ আছে ভাল আর খারাপ দিক যে যেটার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে বা নিতে পারে- সে সেই শ্রেণীর হতে পারে এটা Motivation প্রক্রিয়ার ব্যাপার ইচ্ছে করলে কেও মস্তিষ্কের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে পরিবর্তন করে দিতে পারে Motivated Behavior আমাদের দেশে একটা চক্র আছে যারা এই কাজ করে বেড়ায় এরা হলো আসলে Devilish A Worshiper বা শয়তান সাধক এরা সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হতে চায় স্বার্থ হাসিলের জন্য এরা নিজেদের অনুসারিদেরকে মানুষের বদলে পশুতে পরিণত করে এজন্য এরা স্কুল-কলেজ-মসজিদ-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-অসহায় মানুষের মাঝে তৎপরতা চালায় সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে টিকিয়ে রেখে এরা একটা লুটের রাজত্ব গড়ে তুলতে চায় শুধু আমাদের দেশে নয়, অধিকাংশ দেশেই এরা তৎপর এরা ধর্মের লেবাস পরে থাকে বলে আসল রূপ সহজে ধরা পড়েনা এই চক্র মানুষের মস্তিষ্ক থেকে আস্তে আস্তে Intelligence Quotient বা মানুষের অংশটি নির্জীব করে দেয় তারপর একইভাবে সেই নির্জীব স্থানে ঢুকিয়ে দেয় নিজেদের Devilish Planning ফলে মানুষ রূপান্তরিত হয়ে যায় শয়তান বা পশুতে দেখতে এই মানুষকে মানুষের মতো মনে হলেও আসলে তখন তারমধ্যে বসবাস করে উন্মত্ত নেকড়ে সে তখন শুধু রূপম কেন, পশু নয় এমন সব মানুষকেই হত্যা করতে পারে

পশুর জন্য অভয়ারণ্য দরকার যারা এই পশুদের জন্য অভায়ারণ্য গড়ে দিয়েছে, রূপমের মৃত্যুর দায় থেকে তারাও মুক্ত নয় তাই সবার আগে এই অভয়ারণ্য নির্মূল করা প্রয়োজন তারপর প্রয়োজন মানুষের বাসযোগ্য এক সুন্দর আবাসভূমি গড়ার কাজ শুরু করা

খামে যে দুটো চিঠি ছিল, তার আরেকটি হলো বুনু লেখার ধরনটাই আলাদা আমার জবাব দেওয়া চিঠিতে কোন ফাঁকি না থাকায় ধন্যবাদ জানিয়েছে নিজের ভাগ্যকে খুব প্রশংসিত করেছে এই জন্য যে- গতবার আমার কাছে খুব ভাল করে লিখেছিল, যার কারণেই আমি ভাল লিখেছি উত্তর দিতে দেরী করার জন্য মন খারাপ করতে নিষেধ করেছে স্কুলে অভিনয় প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে তা জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী হলে কী করতো- তা দেখাতে গিয়ে বলেছে, ‘আমি যেহেতু নারী, অতএব নারী অধিকার নিশ্চিত করতাম বেকারদের চাকরির সংস্থান করে দিতাম এরপর সন্ত্রাস নির্মূল করতাম সন্ত্রাসীরা কেন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে- সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করতাম এইসব কাজকর্ম করতাম কিন্তু আমার মনে হয় কি- আসলে আমি প্রধানমন্ত্রী হলে এসব কিছুই করতাম না আর করতে গেলেও তার আগেই বিরোধীদলীয় নেতা/নেত্রী আমাকে গদি থেকে নামিয়ে ফেলতো

আসছে ঈদে সঙ্গে থাকবো না বলে বুনু কষ্টের ব্যাপারটা লিখেছে সঙ্গে থাকলে কতো বেশী মজা হয়- সে স্মরণ করিয়েছে আপা কেন অনেক দিন লিখছেন না তার একটা বিবরণ দেওয়া হয়েছে, ‘আম্মুর লেখার সময় কোথায়? অসুখ থেকে ভাল হতে না হতেই তার কাজ শুরু হয়ে গেছে দেখি, এবার লেখে কি না আপনি কি জানেন, আমরা পানি নিচ্ছি এই পানি নিতে বাধা প্রদান করছে আমাদের পাশের বাসার লোকেরা চিল্লাচিলি- আর গলাবাজী যাদের একমাত্র সম্বল মহা গন্ডগোল বেঁধে আছে সব কথা লেখা সম্ভব নয় আপনি আসলে সব বলবো

 

--------- চলবে-----------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message