রবিবার, ৩০ মে, ২০২১

স্বপ্ন রাতের তারা, আশির দশকের ধারাবাহিক গল্প (পর্ব-৪)

স্বপ্ন রাতের তারা

-        আবুল হোসেন খোকন

ছয়.

আমার ছুটি শুরু কণা খালার বাড়ি রওনা হয়েছি পরশু ঈদ অবশ্য চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করছে আজ দেখা গেলে কালই ঈদ হবে তবে সে দেখা যাবার সম্ভাবনা কম বলে পরশু দিনকেই ঈদের দিন ধরে রাখা হয়েছে

খুব ভোরে উঠতে হয়েছে যতো সকাল সকাল বাস ধরে যাওয়া যায় ততোই ভাল তাহলে বাড়ি গিয়ে সময়টা বেশী পাওয়া যাবে সাধারণত বাসে গেলে ছয় ঘণ্টার পথ আর খুব ভাল কোচ পেলে আড়াই ঘণ্টায়ই পৌঁছে যাওয়া যাবে

ঘুম থেকে উঠেই তৈরি হয়েছি, তারপর পথে নেমেছি আগের রাতে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম এদিক-ওদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজলাম ভাগ্যটা ভাল রিকশা একটা পাওয়া গেল নির্ঝঞ্ঝাটেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালাম সত্যিই যে ভাগ্যটা ভাল তার আরেকটা প্রমাণ হলো- কাউন্টারে একটা মিনিকোচের টিকেট পাওয়া গেল একুশ নম্বর সিট, জানালার ধারে ঈদের ভিঁড়ে টিকেট পাওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার শুভ লক্ষণ দিয়েই যখন শুরু তখন আশা করা যায় দিনটা ভালই যাবে সাতটায় গাড়ি ছাড়বে টিকেটে তাই লেখা আছে এখন বাজে ছয়টা পঁয়ত্রিশ সুতরাং পঁচিশ মিনিট হাতে

নাস্তাটা সেড়ে নেওয়া যায় রমজান মাস কিন্তু আমার ওসব বালাই নেই রোজা থাকি না আমি ওসবে তেমন কোন আস্থাও নেই এই মাসে গরীব আর সাধারণ মানুষকে বেশী কষ্ট করতে হয় আগেই জিনিস-পত্রের দাম বেড়ে যায় বাজারে আগুন লাগে অল্প আয়ের লোকদের জন্য সময়টা হয়ে পড়েমরার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো মিল-কারখানার শ্রমিক, রিকশা, ঠ্যালা, মুটে, কুলি, মাটিকাটা শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বিভিন্ন দিনমজুর আর গ্রামের গরীব জনগণ এমনিতেই সারা বছর অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটায় কারণ তাদের শ্রমের মূল্য বা Labor Assets Value অত্যন্ত নিচু আর রোজার মাসে জিনিস-পত্রের দাম বাড়ার ফলে তাদের আরও কম খেয়ে কাটাতে হয় গরীব জনগণ সারা বছর পুরো খাদ্য জোগাড় করতে না পেরে কৃচ্ছতা সাধনে বাধ্য হন এমনিতে তারা সারা বছর সংযম করেন আর বিপরীতে?

বিপরীতে ধনিরা সারা বছর সুখ-শান্তিতে সেরা সেরা খাদ্যগুলো খেয়ে দিন কাটায় এরাই বলে রমজান হলো সংযমের মাস আসলে ব্যাপারটাই অন্যরকম এই ধনিরা এই মাসে আরও বেশী বেশী ভোগ করে সেরা সেরা খাদ্য, ফল-মূল খেয়ে সাবাড় করে দেয় বাড়ির ফ্রিজগুলো রোজার প্রথমেই ভর্তি হয়ে যায় ভাল ভাল মাছ-মাংস, ফল-মূল দিয়ে সঙ্গে যোগ হয় দুধ, পনির, আঙুর-বেদানার রস, সরবত, ঘি-মাখনসহ কতো কি! ওরা শেষরাতে যা খায়, তা খেতে পারলে গরীব মানুষ দুইদিনও উপোস থাকতে পারবে

একটা ইফতারি প্যাকেটের কথা ধরা যাক না সোনার গাঁ হোটেলে একটা ইফতারির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার টাকায় যেখানে গ্রামের একজন মজুর দিনভর কাজ করে পায় ৩০ টাকা এই এক প্যাকেট ইফতারির সমান তার পনেরো দিনের শ্রম আর ঢাকা শহরের একজন রিকশা চালকের নয়দিনের শ্রমের সমান আমাদের নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী বড় বড় ইফতার পার্টি করে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন ধনিরা ঈদে কেনা-কাটা করতে বিমানে চড়ে বিদেশে যায় এক একজন লক্ষ লক্ষ টাকার জিনিস-পত্র কিনবে আসলে রমজান হলো ধনিদের একটা ভোগের মাস, সংযমের মাস নয়

সুতরাং এই মাসটা আমার জন্য বিদ্রোহের মাস নাস্তা সেড়ে যখন গাড়িতে উঠলাম তখন সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি আর গাড়ি ছাড়লো সাতটা বারো মিনিটে এটাই আমাদের দেশের নিয়ম লেখা থাকে এক আর হবে আর এক গাড়ি টানা ধরতেই ঝিমুনি ভাব, তারপর ঘুম চেপে বসলো এটা একটা বদ অভ্যাস গাড়িতে উঠলেই অবস্থা হবে এখন তো তবু কম আগে একবারে নেতিয়ে পড়তাম যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কতো সময় কিভাবে পার হয়ে যেতো-  আমার বলার উপায় থাকতো না বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকতাম সিটের ওপর

এখনকার ঘুমটাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই কারণ ভোরে উঠতে হবে বলে রাতে ভাল ঘুমানো হয়নি তার আগের রাত এবং দিনেও ঘুমিয়েছি খুব কম সুতরাং এখন খানিকটা ঘুমিয়ে নিলে শরীরটা ঝরঝরে হবে সবচেয়ে বড় কথা বাড়িতে পৌঁছে দারুণ আরাম পাওয়া যাবে তা ছাড়া চলন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে একটা মজা আছে ঠিক ঝুমঝুম বৃষ্টির সময় টিনের চালের নিচে ঘুমানোর মতো

ঘুমুতে হলে অবশ্যই নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে দুই সিট পাশে একটা তরুণ বয়সী লোক বসেছে বেশ চালু মনে হচ্ছে পকেটমার বা প্রতারক হলে সর্বনাশ! পকেট সাফ করে চলে যাবে, টেরটিও পাবো না সুতরাং লোকটি আসলে কে- ভাল কি না, খতিয়ে দেখতে হবে মুখ দেখে তো জানা যাবে না জানতে হলে ভিতরে ঢুকতে হবে আর সেজন্য অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রয়োগ করা ছাড়া উপায় নেই

সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলাম মুহূর্তেই পৌঁছে গেলাম বিশেষ এক স্তরে দেহটা থেকে আস্তে করে বেরিয়ে এলাম নিথর পড়ে থাকা নিজের দেহটার দিকে নজর বুলিয়ে উপরের দিকে ভাসতে থাকলাম যাত্রীতে ঠাঁসা বাস অনেকেই ঝিমুচ্ছে তারমধ্যে আমার নিথর দেহকে আলাদা করে দেখবার কিছু নেই এদিকে-ওদিক খেয়াল করে টার্গেটের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো পিছন দিকে আঁচড়ানো চুল, মুখে বসন্তের দাগ হালকা-পাতলা গরণ জামার ওপর একটা সাধারণ সোয়েটার চোখ দুটো একটু চঞ্চল আমাকে তার দেহের ভিতর ঢুকতে হবে চোখ, মাথাসহ দেহের যে কোন একটা জায়গা দিয়ে মনে করলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে গভীরে বড় বড় করে তাকাচ্ছে ঘ্যাঁচ্ করে চোখের মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম সেখান থেকে সোজা স্টমাক বা পাকস্থলিতে

ইহ্, একেবারে যাতা! বদহজম হতে হতে বুঁদবুঁদি জমে গেছে সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করে না, স্বাস্থ্যের দিকে একবারেই নজর নেই পাকস্থলি থেকে বেরিয়ে ফুঁসফুঁসে ঢুকে গেলাম এটারও অবস্থা ভাল নয় কফ-সর্দি জমে বাজে অবস্থা শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, বড় হচ্ছে থলি কিন্তু নানান রোগে আক্রান্ত সিগারেট মনে হয় উন্মাদের মতো খায় বিড়িও টানে আর কোন নেশার অবশ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না লিভারটা একটু দেখা যাক

নষ্ট, এটাও নষ্ট স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে না চললে অল্প দিনেই খতম হয়ে যেতে হবে থাকুক, এসব দেখে আমার কাজ নেই আমাকে জানতে হবে লোকটা পকেটমার অথবা প্রতারক কি না এজন্য ঢুকতে হবে মাথার মধ্যে, যেখানে মগজ বা ঘিলু থাকে সেখানে ওই জায়গাটার কোন নির্দিষ্ট স্থানে খুঁজতে হবে বের করতে হবে চরিত্র বিষয়ক কেন্দ্র বা Memory Structure জানতে হবে তার Sensory Image লক্ষ কোটি Structure চারদিকে প্রাণী বা জীববিজ্ঞানে ভাল জ্ঞান থাকলে এগুলোর নাম জানতাম কিন্তু কোন জ্ঞান নেই বলে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে খুঁজতে হচ্ছে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার এই একটা গুণ যে, খুঁজতে কোন সময় লাগে না মুহূর্তের মধ্যে চলে যাওয়া যায় টার্গেটে

হ্যাঁ, পাওয়া গেল সেই Memory Structure বাঁচাল টাইপের ছেলে, বেশী কথা বলে তর্কে এবংবহুকিছু পারেএমন একটা ভাব দেখাতে ওস্তাদ মিথ্যা কথায় বা বানিয়ে কথা বলায় জুড়ি নেই তবে ছেলে খারাপ না, অসৎ-চরিত্রহীন না, পকেটমার বা প্রতারকও নয় অভাব অনটন আছে বয়স কম তাই গলায় জোর বেশী অনেক দূরে যাবার উদ্দেশ্য নিয়েই গাড়িতে উঠেছে তার আগেই আমি নেমে যাবো এই ছেলেটি বা লোকটিকে নিয়ে ভাববার কোন কারণ নেই

বেরিয়ে এলাম তার দেহ থেকে আমার নিথর দেহে ঢুকে পড়লাম চোখ খুলে কোলের ওপর রাখা ব্যাগটাকে আরেকটু আরামে বসালাম এবার আরামে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায় সামনের সিটে মাথা ঠেকিয়ে দিলাম তারপর ঘুম জেগে উঠবো একেবারে পাবনা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে

 

--------------- চলবে--------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message