স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
চোদ্দ.
সুষম খেলাধুলার পাগল। আর স্কাউটিংয়ে খুব আগ্রহ।
খুব ভাল আগ্রহ এটা। যদি সঠিক গাইড পেতো, তাহলে মানুষের অনেক উপকার হতো। ঠিক পথটা খুঁজে পেতো। সেই ছোট্ট সুষম আর ছোট থাকতো না।
এমনিতে ও বেশ বুদ্ধিমান। কাছে ডেকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে। আমি অনেক কথা বলতে পারতাম। ডাকতাম, সুষম?
- জ্বী ভাইয়া- ও জবাব দিতো।
- কাছে এসে বসো- ও এসে বসতো।
- কিছু বলবে ভাইয়া?
- হুঁ।
আমি একটা সিগারেট ধরাতাম।
একগাল ধোঁয়া ছাড়তাম গলগল করে।
- সুষম?
- জ্বি ভাইয়া?
- আরও কাছে এসো।-
ও আরও কাছে আসতো। দু’হাতের ওপর থুতনি রেখে তাকাতো।
- খেলাধুলা খুব ভালবাসো, না?
- জ্বি ভাইয়া, দারুণ!
- বিশ্বকাপগুলো তো রাত জেগে দেখেছো, তাই না?
- রাত জেগে মানে কি, তারপর সারাদিনও দেখেছি।
- কার সাপোর্টার তুমি?
- আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার। যা খেলছে না এবার! দারুণ! তুমি কাকে সাপোর্ট করো ভাইয়া?
- আমি কাওকে করি না।
- কাওকে করো না?-
অবাক হয়ে যায় ও।
- না, করি না।
- কেন?
- আগে তুমি বলোÑ কেন তুমি ব্রাজিলকে সাপোর্ট করো?
- কেন করি কেন করি?- চিন্তাবিদের মতো ভাবতে ভাবতে বলবে ও,
কাওকে সাপোর্ট করতে হয়, তাই করি।
- শুধু শুধুই কাওকে সাপোর্ট করবে?
- না, ভাল লাগে তাই।
- ভাল লাগার তো
একটা কারণ থাকতে হবে। কারণ ছাড়া কোন কিছু তো
করা যেতে পারে না।
খুব চিন্তায় পড়ে যাবে সুষম। আঙুলটা চোখের পাশে ওঠা-নামা করাতে করাতে বলবে, তাই তো, কোন কারণ তো
জানি না।
আমি হেসে ফেলবো।
- আসলে কারণ নিশ্চয়ই আছে, তুমি ধরতে পারছো না। হয়তো তোমার বন্ধু-বান্ধবরা সাপোর্ট করে, তাই তুমিও করো।
অথবা তোমার প্রতিদ্বন্দ্বি কেও অন্যদলকে সাপোর্ট করে।
তুমি তার বিপরীতে আরেকটিকে সাপোর্ট করছো।
- হ্যাঁ ঠিক, তাই হবে। ওই যে আমাদের ক্লাসের সান্টু, ব্যাটা কিচ্ছু বোঝে না। ওস্তাদি করে। ওই ব্যাটা ইতালিকে সাপোর্ট করে। এবার বুঝুক, ব্রাজিলের কেমন মার।
- আচ্ছা সুষম, আমাদের দেশকে ভালবাস না?
- জ্বি ভাইয়া, দেশের পক্ষে তো থাকতেই হবে।
- আর কাকে সাপোর্ট করো?- আঙুল ওঠা-নামা করিয়ে ভাববে কিছুক্ষণ।
তারপর বলবে-
- পাকিস্তানকে সাপোর্ট করি।
- কেন?
- কারণ ওরাও মুসলমান, আমরাও মুসলমান।
- কিন্তু ওরা তো
আমাদের দেশের ওপর হামলা চালিয়েছিল। ৭১ সালে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছিল।-
চিন্তায় পড়ে যাবে সুষম-
-কিন্তু আমি ওসবের কিছু জানি না। আর খেলার ব্যাপারটা আলাদা। এটার সঙ্গে ৭১
সালের সম্পর্ক নেই।
- তা নেই ঠিক।
কিন্তু এই খেলাকে সমর্থন করতে গিয়ে এইদেশে পাকিস্তানী পতাকা ওড়াতে হবে? আজকাল তো সেটাই দেখা যাচ্ছে।
খুব গম্ভির সুষম, তাই তো। এটা তো
ঠিক না।
- এটাই হচ্ছে। আর এভাবেই শত্রæদের প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে। তাছাড়া কিছু বেঈমান লোক তো এটাই চাচ্ছে। ধর্মের কথা বলে লোকজনকে ভোলাতে চেষ্টা করছে।
- হুঁ, খুব চিন্তার কথা।- সুষম নিজেও খুব চিন্তায় পড়ে যাবে।
- সুষম?
- জ্বি ভাইয়া?
- যাতে আমাদের দেশের লাভ নেই, বেশীরভাগ মানুষের লাভ নেই, এমনকি তোমার-আমারও লাভ নেইÑ তারপক্ষে থাকা উচিত নয়। হোক সে
ব্রাজিল, ইতালি, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড বা পাকিস্তান। সুষম?
- জ্বি ভাইয়া?
- আমাদের এই দেশে ৯০ ভাগ মানুষ বড়
কষ্টে জীবন-যাপন করে। খুব কষ্টে।
বৃষ্টি নামলেই পানি পড়েÑ এমন কুড়েঘরে থাকে। অনেকেই গাছতলায়, ফুটপাতে ঘুমায়। খেতে পায় না। ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে খায়। অন্যের ফেলে দেওয়া এঁটো চেখে পেট ভরাতে চায়।
তাঁদের ছেলে-মেয়েরা একেবারে রাস্তার কুকুরের মতো বেঁচে থাকে।
এটা একটা বড়
সমস্যা। তোমার কি
মনে হয়?
- এমন হলে তো
চিন্তার কথা! আমরা তো তেমন কষ্ট করি না।
- না, করি না। খুব অল্পসংখ্যক লোক এই কষ্ট ভোগ করি না। কিন্তু আমরাও যে মানুষ, ওরাও সেই মানুষ। তাহলে ওরা কুকুরের মতো থাকবে কেন? অসংখ্য মানুষ কষ্টে থাকবে, আমরা সুখে থাকবোÑ এটা কি
হতে পারে? কোন মানুষের পক্ষে কি
এটা মেনে নেওয়া সম্ভব?
- তা অবশ্য নয়।- চিন্তিতভাবে বলবে ও।
- আমি কেন খেলা পছন্দ করি না
শুনবে?
- বলো।
- আমাদের এই গরীব দেশে খেলাটা বড় নয়। বড় হলো, সমস্যাটা। কিন্তু সেটাকে দেখা হয় না। খেলাটাই বড় হয়ে আসে। কারণ, কারও পক্ষ থেকে একটা সাংঘাতিক বিদ্রোহ চাপা দেওয়া প্রয়োজন। এটা করতে হলে খেলাধুলার মতো বিষয়গুলোকে সামনে আনা প্রয়োজন, ধুম-ধারাক্কা সিনেমা প্রয়োজন, ডিশ এন্টেনা-পপ-ডিসকো গান প্রয়োজন।
আরও এরকম ফুর্তির জন্য কতো কি
প্রয়োজন। সবাইকে একটা কিছুতে মাতিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে হবে তো, তাই। -আমি উঠে দাঁড়ালাম।
- সুষম চলো ছাদে যাই।
খালার এই বাড়িতে ছাদ আছে। কিন্তু ওঠার সিঁড়ি নেই। তবে কল্পনায় সিঁড়ির প্রয়োজন হয় না। ইচ্ছে করলেই ছাদে ওঠা যায়।
আমি আর সুষম ছাদে। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানলাম।
- ৫০ লক্ষ টাকার লটারি নিয়ে খুব মেতে উঠেছিলে না?
তুমি বলেছিলে, খেলাধুলার উন্নয়ন হচ্ছে দেশের গৌরব। দেশের স্বার্থে ১০ টাকা দিয়ে সবারই একটা টিকেট কেনা উচিত। হ্যাঁ, আমিও বলি কেনা উচিতÑ যদি এই দেশটা সব
মানুষের হতো। শুধু একটা পক্ষের না হতো। এখন খেলাধুলার গৌরব মানে হচ্ছে একটা পক্ষের গৌরব। এই পক্ষটাই ক্ষমতায়। এদের গৌরবে বড়
পক্ষের কোন লাভ নেই। লটারির লোভ দেখিয়ে একটা পক্ষ বিপুল লাভ করে।
তা ছাড়া গৌরব-টৌরব জাহির করতে পারলে ওরা এই
দেশটার নামে বিদেশ থেকে আরও ঋণ
আনতে পারে। ঋণটা বেশীরভাগ মানুষের কোন কাজে আসে না,
কিন্তু ঋণের বোঝাটা ঠিকই ঘাড়ে চাপে।
আর ঋণের টাকাটা চলে যায় ওই
ক্ষমতাধরদের পকেটে। সুষম?
- হুঁ।
- ক’টা বাজে দেখোতো।
- চারটা বেজে আট
মিনিট।
- তাকিয়ে থাকো ঘড়ির দিকে।- সুষম তাকিয়ে থাকে। সময় পেরুতে থাকে।
- এখন কতো বাজে সুষম?
- চারটা বেজে নয়
মিনিট।
- তারমানে এক মিনিট চলে গেল।
- হ্যাঁ।
- এই একটা মিনিট জীবনেও তুমি বা
আমি কেও ফিরে পাবো না। আমাদের বেঁচে থাকার যে সীমা আছে, সেখান থেকে একটা মিনিট চলে গেল।
অথচ এই একটা মিনিট আমরা কোন কাজে ব্যবহার করিনি।
- আরও প্রায় এক
মিনিট চলে যাচ্ছে।
- হ্যাঁ, জীবন থেকে এভাবে সময় চলে যাচ্ছে, যে সময়টাকে আমরা কাজে লাগাইনি। অসংখ্য মানুষ এভাবে সময় নষ্ট করছি। কিন্তু শত
শত হাজার হাজার, বা কোটি কোটি মানুষ যদি এই
সময়টাকে একটা প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতো, তাহলে অন্যরকম কিছু ঘটে যেতো। এগারো কোটি মানুষ যদি এক মিনিট করে এগারো কোটি মিনিট সুন্দর পৃথিবীর জন্য একযোগে কাজ করতো?
- কী সাংঘাতিক ব্যাপার! কী যে হতো ভাইয়া?- চকচক করে ওঠে সুষমের চোখ। আমি হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।
হাতের সিগারেট পুড়ছে।
আমি নিরব নিস্তব্ধ।
পনেরো.
খালার বাড়িতে থাকার সময় রাতে বেড়ানোর উপায় নেই। অথচ রাত হলো বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। যারা নিশাচর তারা এটা জানে।
জোৎস্না রাতে ছাদে বেড়াতে কতো আরাম, যারা বেড়িয়েছে তারা জানে।
এই রাতে গ্রামের মেঠোপথ, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর মাড়িয়ে যারা হেঁটে গেছে তারা জানে রাতের মর্ম কি। গভীর রাতে শহরের ফাঁকা রাস্তাগুলোতে হনহন করে হেঁটে এক অদ্ভুৎ অনুভূতি পাওয়া যায়, যা দিনের বেলা বা
অন্য সময় পাওয়া যায় না। জোৎস্না রাতে মনটা পবিত্র থাকে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়ালে যেমন হৃদয়টা বি-শা-ল হয়ে যায়, রাতে মানুষের মনকে তার কাছাকাছি নিয়ে যায়।
এই সময় সুখ-দুঃখের দুয়ার খুলে যায়। খালার বাড়িতে এই সুযোগটা নেই।
তাই কোন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গেই হৃদয় খুলে কথা বলতে পারি না। কতো দিন পারি নাÑ কোন হিসেব নেই। আমার বন্ধুরাও সেই সুযোগ পায় না। তাই হয়তো সম্পর্কটাও আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগে ক-তো বন্ধু ছিল, এখন নেই। একদিন হয়তো আরও থাকবে না।
এদিকে আমার ছুটি ফুরিয়ে এসেছে। আর মাত্র একটা দিন হাতে। এরমধ্যে অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি, আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
তবে সবচেয়ে বড়
কথা অনেক অনেক জনের সঙ্গে দেখা করা হবে না। দেখা করা হবে না গ্রামের সেই মানুষগুলোর সঙ্গে, যারা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকে।
শহরের এই খাঁচার মতো দালান-কোঠায় তারা বাস করে না। তারাই সত্যিকারের মানুষ। মানুষের মনকে বড়
করতে হলে হয়
সমুদ্রের ধারে দাঁড়াতে হয়, আর না হয় জঙ্গলে গিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে হয়। কেও যদি জঙ্গলে গিয়ে জঙ্গলের মানুষ হয়ে যান, জামা-কাপড় সমস্ত কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনÑ তিনিই কেবল মহামানব। তাছাড়া মানুষ তো
জঙ্গলেরই। পূর্ব পুরুষ যেহেতু পশু ছিল, জঙ্গলে বাস করতো।
অথচ জঙ্গল ছেড়েই মানুষ অমানুষ হয়ে উঠেছে। এখনও কিছুটা মানুষ পাওয়া যায় গ্রামে গেলে। কিন্তু সে সুযোগটাই হাতে নেই।
---------চলবে-------