স্বপ্ন রাতের তারা
- আবুল হোসেন খোকন
সাত.
পাবনা এক অন্য প্রকৃতির শহর। বিশেষ করে বহিরাগতদের জন্য। ধরা যাক আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। হঠাৎ কোন তরুণের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো। দোষটা আপনার নয়। ওই তরুণ না দেখে এলোমেলো হাঁটছিল। ধাক্কা লাগার পর আপনার পিতা-মাতাসহ চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে গালি দেবে ওই তরুণ। আপনি আপত্তি করেছেন কি মরেছেন। সঙ্গে সঙ্গে চাক্কু ঢুকবে আপনার ভুঁড়িতে। এখন অবশ্য পাইপগানের যুগ এসে গেছে। তাই আপনি গুলি খাবেন।
এই শহরের প্রায় সব কিশোর-তরুণ আর উঠতি যুবকদের কোমড়ে ছোড়া, চাক্কু, পাইপগান, না হয় জর্দার কৌটা (ককটেল বোমা) থাকবেই। আপনি কোন দোকানে পান কিনতে গিয়েও যদি কটু কথার উত্তর দেন, তো গুলি বা চাক্কু খেতে পারেন। এ নিয়ে পরিচিত কাওকে বলে-কয়ে যদি বিচার চান তো একেবারে মরেছেন। তখন দলে দলে, পাড়ায় পাড়ায় বন্দুকযুদ্ধ এবং খুনোখুনি শুরু হয়ে যাবে। সুতরাং অন্য শহরের লোকদের জন্য পাবনা বড় বিপদজনক জায়গা।
এই জেলার উৎপত্তি বা গোড়ার সঙ্গে এখনকার যোগসূত্র আছে কি না- কে জানে। পাবনার নামকরণ হয়েছিল নাকি পবন ডাকাতের নামে। এই ডাকাত ছিল এ অঞ্চলের রাজা। তার নামে রাত নামতো, দিন হতো। ভারত উপমহাদেশের নেতারা এজন্য এই জায়গার নাম দিয়েছিলেন পবন ডাকাতের এলাকা। তারপর শেষ পর্যন্ত জায়গাটার নামই হয়ে গেছে পবন থেকে পাবনা। এই পাবনার দুর্নাম আছে ঠিক, কিন্তু সুনামও আছে অনেকগুণ বেশী। এরও কারণ সম্ভবত পবন ডাকাত। সে গরীবের বন্ধু ছিল, ধনপতিদের যম ছিল। তাই শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে পাবনার নাম শীর্ষ স্থানে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ১৯৬৮ সালে এখানে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভাতের বদলে ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। এ নিয়ে দেশে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আর পাবনায় ঘটেছিল সশস্ত্র বিদ্রোহ। বন্দুকের দোকার লুট করে ক্যাপ্টেন জায়েদি নামে এক মুসলিম লীগ নেতার বাড়ির ওপর ছাত্র-জনতা আক্রমন করেছিল। মুসলিম লীগের সশস্ত্র গুন্ডা এবং পুলিশ বাহিনীর মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে দিন-দুপুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যুদ্ধ করেছিল ছাত্র-জনতা। এরকম আরও অনেক ইতিহাস আছে পাবনাবাসীর। ১৯৭১ সালেও পাক বাহিনী প্রথম পরাজিত হয়েছিল পাবনায়। ২৬ মার্চ থেকে দুইদিনব্যাপী যুদ্ধ করে মুক্ত করা হয়েছিল শহরকে। তারপর ১১ দিন স্বাধীন ছিল জেলা। ’৮২ সালে জেনারেল এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেছিল, তখনও এখানকার ছেলেরা আগে-ভাগে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। এরশাদ হটাও আন্দোলন শুরু হবার পর গোটা দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম এখানে এক প্রতিমন্ত্রীর জনসভা ভেঙে, তার গাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। শত শত পুলিশ দিয়েও ওই মন্ত্রী সভা করতে পারেনি। শুধু ছাত্র-জনতা কেন- যারা গান গায়, নাটক করে, ছবি আঁকে এমন শিল্পীরাও এখানে জরুরি আইন ভেঙেছিল দেশের মধ্যে সর্বপ্রথম।
বেশীদিন আগের কথা নয়। তারিখটা ছিল ১৯৮৭ সালের ২৮ নভেম্বর। এই জরুরি আইন ভাঙা নিয়ে মজার ঘটনা ঘটেছিল। এর দু-একটা বলা যেতে পারে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংগঠন-এর মোট ১২টা সাংস্কৃতিক দল জরুরি আইন ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২৭ নভেম্বরে সামরিক শাসক এরশাদ সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল। বলা হয়েছিল মিছিল, মিটিং, রাজনীতি নিষিদ্ধ। দেখামাত্র গুলি করা হবে। এর ক’দিন আগে থেকেই ঢালাও গ্রেফতার অভিযান শুরু করা হয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। জরুরি আইন জারির সঙ্গে সঙ্গে সবাই উধাও। গভীর গ্রামের দিকে চলে গেছেন সবাই। আছে শুধু এই শিল্পীরা।
কী আর করা! সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েছে, তখন তা সফল করতেই হবে। আইন ভাঙার জন্য তাই সাংস্কৃতিক নেতারা খেটে-খুটে সব প্রস্তুতি শেষ করেছেন। এই দলে চাঁদ নামে এক কর্মী ছিল। পুরো নাম মিজানুর রহমান চাঁদ। বেচারা খুব হম্বি-তম্বি করছিল, ‘মিছিলে পুলিশ হামলা চালালেই হয়, কাকীমার অবস্থা কী হয় এবার দেখবো। তাড়া করলে তো দৌঁড়াতে পারবেন না। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কেমন মজা হয় এবার দেখবো।’ চাঁদের কথায় কেও কেও সায় দিচ্ছিল।
মীরা কাকীমা হলেন শিল্পীদের সবার কাকীমা। এমনিতে তার মতো ভাল মানুষ আর হয় না। কিন্তু তার সামান্য দোষ আছে। তিনি সাংস্কৃতিক কাজের জন্য সব করবেন। যতো টাকা লাগে দেবেন, দিনরাত খাটবেন, খোঁজ-খবর নেবেন। বিনিময়ে তিনি চান স্বীকৃতি। স্বীকৃতি বলতে তিনি যে এতোকিছু করছেন, তা ছেলেদের মুখে শুনতে চান। আর চান অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠানগুলোতে একটু বক্তৃতা দিতে। কিন্তু ছেলেরা তা হতে দেবে না। সব সাহায্য নেবে অথচ স্বীকৃতি দেবে না। আর এটা নিয়েই ছেলেদের সঙ্গে কাকীমার ঠান্ডা যুদ্ধ চলে সব সময়। অবশ্য ছেলেরা যে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এমন করে তা নয়। কাকীমা রেগে যান, তাই ছেলেরা মজা পায়। ইচ্ছে করে তারা ঝামেলা সৃষ্টি করে। কাকীমা অতোশতো বোঝেন না বলে রেগে টং হয়ে থাকেন। কাকীমাকে পুলিশের হাতে ফেলে রেখে চলে আসার এক গোপন পরিকল্পনা নিয়ে চাঁদ খুব আনন্দ পাচ্ছিল। আরও অনেকে এতে উৎসাহ যোগাচ্ছিল।
২৮ নভেম্বর সকাল ১০টা। পরিকল্পনা মতো এক এক করে সব শিল্পীরা এসে জড়ো হচ্ছিল বনমালী ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে। বনমালী ইনস্টিটিউট হলো পাবনার বহু পুরনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। অবিভক্ত ভারতবর্ষের সময় বনমালী নামে একজন শিল্পীমনা হিন্দু এই প্রতিষ্ঠানটি নিজের চেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন। তিনি শিল্পীদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি রেখে যান। শর্ত হলো, এই প্রতিষ্ঠানটি অবশ্যই সাংস্কৃতিক মহলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করবে, শিল্পীদের স্বার্থরক্ষা করবে। বর্তমানে অবশ্য যারা এই প্রতিষ্ঠান দখল করে আছেন, তারা ওই শর্তের ধার ধারেন না। তাই জরুরি আইন ভাঙার সঙ্গেও বনমালীর সম্পর্ক নেই। বরং বিপক্ষে আছে- এটাই সত্য কথা। যাই হোক, শিল্পীরা যখন সবাই এসে গেল তখন শুরু হলো মিছিল।
এদিকে আরেক ব্যাপার ঘটে গেছে। কোথা থেকে যেন পুলিশের গোয়েন্দারা খবর পেয়েছিল সকাল ১০টায় এডওয়ার্ড কলেজ থেকে মিছিল বের হবে এবং জরুরি আইন ভাঙা হবে। গোয়েন্দাদের এই ভুল তথ্যের জন্য পুলিশের বিরাট দল গিয়ে জড়ো হয়েছে এডওয়ার্ড কলেজে। বনমালী থেকে এডওয়ার্ড কলেজের দূরত্ব না হলেও দুই কিলোমিটারের কাছাকাছি। তাই এদিকে যে জরুরি আইন ভঙ্গ করে মিছিল বেরিয়ে পড়েছে, বেচারারা সেটা জানতেই পারেনি। আরেক ব্যাপার ঘটেছে কাকীমার বাড়িতে। মিছিলে বিপদ হতে পারে এটা কাকীমাও বুঝেছেন। তারসঙ্গে আসার কথা পুত্র-কন্যা যথাক্রমে অঞ্জন আর দীপা’র। দীপা ভার্সিটিতে পড়ে, অঞ্জন স্কুলে। কিছুতেই ওদের মিছিলে আসা থেকে থামানোর উপায় নেই। কিন্তু কাকীমা আসতে দেবেন না। কী জানি যদি জেলে যেতে হয়! কাকীমার ভাবসাব দেখে অঞ্জন পালিয়ে চলে এসেছে। আর ধরা পড়ে গেছে দীপা। কাকীমা তাকে একটা রুমের মধ্যে তালা দিয়ে বন্দি করেছেন। তারপর নিশ্চিন্তে মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছেন। কিন্তু মিছিল তার আগেই বেরিয়ে গেছে। তিনি আর সেই জঙ্গি মিছিলের নাগাল পাননি।
এদিকে ‘হটাও এরশাদ, বাঁচাও দেশ’ ‘শিল্পী জনতা বাঁধো জোট’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠেছে। বুলেটের মতো মিছিল ছুটছে রাজপথ দিয়ে। জনসাধারণ থ। যেখানে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ রয়েছে, সেকানে থ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই দুঃসাহসী মিছিলের ব্যাপারটি মগজে ধারন করতে মনে হয় লোকজনের বেশ সময় লেগেছিল। তারপর যেই না মগজে ঢুকেছে, ওমনি চারদিকে শুরু হয়ে যায় ঘরাৎ, ঘটাং, হুটপাট করে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করা, আর আতঙ্কিত লোকজনের পলায়ন। কারণ তারা মনে করেছে পুলিশ গুলি চালালো বলে। রাস্তায় জ’না ছ’য়েক পুলিশও টহল দিচ্ছিল। বেচারা পুলিশরা গুলি করবে বা মিছিলে বাধা দেবে কি- নিজেরাই জনগণ হয়ে গেল। রাইফেল নিয়ে দে ছুট। তারা মনে করেছে- জরুরি আইন ভেঙে যারা মিছিল বের করেছে, তারা নিশ্চয়ই তৈরি না হয়ে নামেনি। ওরকম জ’না ছ’য়েক পুলিশ পেলে তারা ভত্তা বানিয়ে ফেলবে। তাই তারা জান-প্রাণ নিয়ে থানার পথে দৌঁড়ানো শুরু করে।
শতাধিক শিল্পীর এই বিরাট মিছিলটি গোটা রাজপথ প্রদক্ষীণ করে, স্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হুলস্থুল কারবার করে ফেললো। কোন বাধা না আসায় সাহস বেড়ে যায় কয়েকজন নেতার। তারা ঠিক করে ফেললো ডিসি অফিসের সামনে দিয়ে মিছিল করবো। ছুটলো মিছিল ডিসি অফিসের দিকে। কয়েকজন নিষেধ করলো। কিন্তু অতি লোভে তাঁতী নষ্ট বলে একটা কথা আছে। শিল্পীদের দশা হলো তাই। মিছিল ডিসি অফিসের সামনে দিয়ে বামে যাবার কথা ছিল। কারণ ডানে পুলিশ লাইন। মিছিল বামে না গিয়ে ডানে রওনা হলো। পুলিশ লাইনে সারি সারি পুলিশ প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। মিছিল এগিয়ে গেল, তারা কিছুই বললো না। পাশ কাটিয়ে যখন চলে যাচ্ছে মিছিল, তখন পিছন থেকে শত শত পুলিশ লাঠি, রাইফেল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সামনের দিক থেকে এগিয়ে এলো পুলিশের কয়েকটি সশস্ত্র ট্রাক। বাম পাশে জেলখানার দিকে ঘাঁপটি মেরে থাকা আরও পুলিশ আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো। তিনদিক থেকে ঘেরাও হয়ে গেল শিল্পীরা। ডানের ফাঁকা দিকটায় ঝোঁপ-ঝাঁড়-দোকানপাট মাড়িয়ে যে যেমন পারলো আত্মরক্ষার জন্য দৌঁড়ালো। গ্রেফতার হলো তিনজন। গণশিল্পী’র উত্তম কুমার দাস, উদীচী’র অমিয় চৌধুরী আর মিজানুর রহমান চাঁদ। যে চাঁদ কাকীমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল, এখন সে নিজেই ধরা পড়লো।
----------- চলবে -----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message