স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
নয়.
বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। এরমধ্যে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। অনেকগুলো জায়গায়ও গিয়েছি। এ ক’দিনের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো বলার আগে পাবনা শহরটা সম্পর্কে আরও কিছু না বললেই নয়।
ঢাকায় শহর বলতে যেমন বিরাট এলাকাকে বোঝায়, এখানকার ব্যাপারটা তার পুরো উল্টো। ব্যস্ততম এলাকা বলতে মাত্র এক কিলোমিটারেরও কম জায়গা। টার্মিনাল থেকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার কিছু আগে থেকে শহর শহর ভাব। বলা যেতে পারে বাণী সিনেমা থেকে উত্তরমুখে ট্রাফিক মোড় পর্যন্ত শহুরে ভাব। জোর-জবর করে জেলা প্রশাসন বা কোর্ট এলাকা থেকে ট্রাফিক মোড় হয়ে পশ্চিমের নতুন ব্রিজ পর্যন্ত ধরা যায়। ঢাকার পুরানা পল্টন, প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ব্যাংক, গুলিস্তান, মিরপুর, শাহবাগ, সায়েন্সল্যাবরেটরি, নিউ মার্কেট, ফার্মগেট এলাকা যেমন ব্যস্ততম, পাবনা শহরের এই এক কিলোমিটার মতো জায়গা তেমনই। বাকি সব চট্টগ্রামের মতো ঠান্ডা। চট্টগ্রামের মূল শহরের আশপাশটা যেমন ফাঁকা, এখানে কেবল সেটাই ব্যতিক্রম।
এই এক কিলোমিটারের মধ্যে রিকশা, ঠ্যালা, সাইকেল, ট্যাক্সি, স্কুটার ঠাঁসাঠাঁসি। আছে বিপণি কেন্দ্রগুলো। রাস্তার ধার দিয়ে অফিস বলতে আছে ব্যাংক। খুব সরু এই রাস্তার নাম ‘এ হামিদ রোড’। নতুন ব্রিজ থেকে বাণী সিনেমা পর্যন্ত আসতেই পড়বে প্রথমেই ঘোড়া স্ট্যান্ড। এটা আদিকালের শেষ চিহ্ন। এখন বিলুপ্তির পথে। হয়তো আর দু’চার বছর পর ঐতিহ্যবাহী এই স্মৃতি আর থাকবে না। সব আধুনিক বিপণি এলাকা হয়ে যাবে। ট্রাফিক মোড় ঘুরে ডানে এগুতেই বামে পড়বে প্রেসক্লাব। দেশের মধ্যে পুরনো প্রেসক্লাব বলতে যে দু’একটি আছে- এটা তার অন্যতম। এখান থেকেই সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সৃষ্টি হয়। আরও নানা কারণে ঐতিহ্য আছে এ ক্লাবের। তবে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বা স্বার্থান্বেষী মহল এই ক্লাবের বিরুদ্ধে অনেকবার শত্রুতা করেছে। এরশাদ আমলে এই ক্লাবের সুনাম নষ্ট করতে অনেক কান্ড করা হয়েছিল। একজন প্রতিমন্ত্রী একেবারে মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। মোটা টাকা ঢেলে আর অসৎ প্রবৃত্তি কাজে লাগিয়ে হলুদ সাংবাদিক তৈরি করেছিল।
পাবনা শহরে ঐতিহ্যবাহী এবং পুরনো মিষ্টির দোকান আছে দু’টি। একটি লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, আর একটি প্যারাডাইস সুইট মিটস। দু’টোই রাস্তার ডানে, অর্থাৎ পশ্চিম পাশে পড়বে। লক্ষ্মীতে বেশীরভাগ সময় বসেন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সকালের দিকে কাউন্টারের পরের আসনগুলোতে তাঁরা বসবেন। বিকেলে চেয়ার-টেবিল পেতে বাইরে বসবেন তাঁরা। এঁনারা কেও প্রবীণ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, কেও আইনজীবী কিংবা কলেজের অধ্যাপক। এই স্থান পেরিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন আর বাসস্ট্যান্ড পড়বে। এই স্ট্যান্ডে এখন দিনের বেলা কোন স্টপেজ নেই। তবে এখানে ঢাকা, বগুড়া, রাজশাহী, যশোর, রংপুর, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাবার জন্য কোচের টিকেট পাওয়া যায়। স্ট্যান্ড জুড়ে কাউন্টার। এর পরে আছে ডায়াবেটিক সমিতি, শিশু হাসপাতাল। যেটা চালান লায়নিজম করেন এমন সব ব্যক্তিরা। লায়নিজম মানে সিংহতন্ত্র। মানুষ হয়ে তারা যে কেন পশুতন্ত্রের নাম ব্যবহার করেন সেটা একটা বড় রহস্য!
এই হলো পাবনা। এ হাসপাতালের পরেরটাই প্রবীণতম অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি এবং সামনে টাউন হল ও বনমালী। গোটা দেশ পাবনাকে যে জিনিসটার জন্য বেশী মনে করে সেটা হলো- এখানকার সুবিশাল মানসিক হাসপাতাল। অবশ্য এটা শহর থেকে আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরে, প্রায় গ্রামের মধ্যে। যেতে হয় রিকশায় অথবা ব্যক্তিগত যানবাহনে। প্রেসক্লাব, লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, ডায়াবেটিক সমিতি, অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি- এসব ক’টি জায়গায়ই আমাকে ঢু মারতে হয়েছে। এ ছাড়া গিয়েছি খোকা ভাই আর বাবু’র দোকানে। এ দু’জন হলো আমার খুব ভক্ত এবং প্রিয়। দু’জনেই খুব ভাল এবং দেশপ্রেমিক। এই খোকা ভাই কোন রাজনৈতিক দল করেন না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর গণতন্ত্র তাঁর একটা বড় চাওয়া। ’৯০-এ এরশাদ পতন আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনগুলোতে তিনি মিছিলে যেতেন। পুলিশ এবং মিলিটারির ভয়ে তখন অনেকেই মিছিল করতে আসতো না। সন্ধ্যে বেলা জরুরি আইন ভঙ্গ করে গুলির মুখে যে জঙ্গি এবং ঝটিকা মিছিল বের হতো, তাতে লোকসংখ্যা থাকতো ১৫/২০ জন। তারমধ্যে নির্দলীয় খোকা ভাই একজন। মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের ভয়ঙ্কর তাড়া খেয়ে একটা পা ভেঙে গিয়েছিল খোকা ভাইয়ের। তারপর ক-তো মাস কষ্ট! অপারেশন করতে হয়েছিল। পায়ে গ্যংগ্রিন মতো হয়ে গিয়েছিল। এসবে হয়তো দুঃখ থাকতো না খোকা ভাইয়ের। কিন্তু এরশাদ পতনের পর যখন কোন আশাই পূরণ হলো না, তিনজোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন হলো না, গণতন্ত্র এলো না- তখন থেকে খোকা ভাই একেবারে ভেঙে পড়েছেন।
খোকা ভাইয়ের দোকানটা হলো ‘এ হামিদ রোড’-এ, পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের উত্তরে। আর বাবুর দোকান কৃষ্ণসুন্দর সাহা রোডে। এটা প্রেসক্লাবের দক্ষিণে একটি গলির পরে। বাবু খুব চাপা ছেলে। মনের দুঃখকষ্টের কথা কারও কাছে প্রকাশ করবে না। কথা কম বলে। ওর জীবনটায় অনেক ব্যাথা আছে। কিন্তু তার প্রকাশ নেই। এরমধ্যে একটা সমস্যা হয়েছে। সেটা হচ্ছে খোকা ভাইকে কেন্দ্র করে। দু’জনের খুব মিল। কেও কাওকে ছাড়া বোঝে না। যেহেতু আমার সঙ্গেও ওদের একটা গভীর সম্পর্ক, তাই সমস্যাটায় আমাকেও জড়িয়ে ফেলেছে। পাবনার যতো খবর তার সব আমাকে জানায় খোকা ভাই। খুব ঘন ঘন চিঠি দেয় সে। অথচ গত দু’মাস ধরে সেই খোকার কোন চিঠি পাচ্ছিলাম না। আমি চিঠি দিয়েও উত্তর পাইনি। বাবুও কিছু বলতে পারেনি। তবে পাবনা আসার বেশ কিছুদিন আগে আমার একটা চিঠির জবাব দিয়েছিল বাবু। যা লিখেছিল তার মূল কথা হলো, ‘খোকা ভাই কেমন আছে জানতে চেয়েছেন। তিনি এখন তার ভাগ্নেদের নিয়ে ব্যস্ত। ভাগ্নেরা ভাল থাকলে খোকা ভাই ভাল থাকেন। আর ভাগ্নেরা খারাপ থাকলে তিনিও খারাপ থাকেন। আমরা আর কে? আমাদের কথা মনে রাখার সময় কোথায় তার?’
চিঠিটা আমাকে অনেককিছু পরিস্কার করে দিয়েছিল। সমস্যাটা জটিল। শুনেছিলাম খোকা ভাই একদল ভাগ্নে জুটিয়ে নিয়েছেন এবং দোকানে বসে সারাদিন তাদের সঙ্গেই সঙ্গ দেন। বাবু আর খোকা ভাইয়ের মধ্যে একটা চির ধরেছে, সেটা ওই চিঠিতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আমি প্রথমে দেখা করি বাবুর সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এইসব জটিল বিষয়গুলো আর তুলবো না। আগে পর্যবেক্ষণ করবো, পরিস্থিতি বুঝবো। তারপর যা করা প্রয়োজন করবো। দেখা হবার পর বাবু ওসব নিয়ে কিছু বললো না। রাতে খোকা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবার পরও ওইসব সমস্যার কথা তুলিনি। ঠিক তখনই বাবু এলো। দোকানে বসে আমরা। তিনজন হবার পর নতুনভাবে গল্প শুরু হলো। চললো অনেকক্ষণ। এরমধ্যে খোকা ভাইয়ের হুকুমে চা-নাস্তাও এলো কয়েকবার। আমার মাথার মধ্যে অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনজন এক হতে পারলাম, আগের মতোই গল্প হচ্ছে, তাহলে সমস্যাটার কি হলো? জবাব একটাই হতে পারে তা হলো, সংকট কেটে গেছে। এ রকম সংকট আগে ক-তো হয়েছে। এভাবেই সব কেটে গেছে। যাক, বাঁচা গেল। ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত আর ভাবার দরকার নেই। পরে তোলারও দরকার নেই। বরং পাস্ট ইজ পাস্ট। তাকে আর টেনে না আনাই ভাল।
ক’দিনে দেখা-সাক্ষাতের আরেকটি জায়গা ছিল গণশিল্পী। গিয়েছিলাম এই সংগঠনের অফিসে। হামিদ রোড থেকে পূবে সোনাপট্টিতে অস্থায়ী অফিসঘর। ’৮০-এর দশক জুড়ে পাবনায় কয়েকটি নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। এগুলো হলো থিয়েটার-৭৭, অনুশীলন আশি, মহিলা পরিষদ, খেলাঘর আসর, ড্রামা সার্কেল, আবৃত্তি সংসদ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী আর গণশিল্পী সংস্থা। এদের আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং সমাজ বিপ্লবের জন্য শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্র রচনা করা। চেতনার মশাল জ্বালার জন্য এঁরা কাজ করতো শহরের স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, মঞ্চ, রাজপথ, গলিপথ, ফুটপাত এবং গ্রামে। শহরে কাজ হতো সাধারণ মানুষের মধ্যে এবং গ্রামে কাজ হতো কৃষক-শ্রমিক-মজুরের মধ্যে। কাজের হাতিয়ার ছিল নাটক, গণসঙ্গীত, জাগরণমূলক গণনৃত্য-কবিতা, বক্তব্য, আলোচনা, চলচ্চিত্র-আলোকচিত্র-পোস্টার প্রদর্শনী ইত্যাদি। গোটা ’৮০-এর দশক জুড়ে কখনও সামরিক শাসন, কখনও সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী তৎপরতা, কখনও সরকার-প্রশাসন বা ক্ষমতাধর গণবিরোধী ব্যক্তি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এইসব নাট্য ও সাংস্কৃতিক শিল্পীরা সর্বাত্মক তৎপরতা চালিয়েছে। ওই সময়গুলোতে প্রায়ই দেখা যেতো ফুটপাতে শিল্পীরা গাইছে, ‘জাগো অনশন বন্দি ওঠরে যতো’ ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ ‘বিপ্লবের রক্তরাঙা ঝান্ডা ওড়ে আকাশে’। কিংবা কোন জনসমাবেশের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ভেসে আসছে নাট্যশিল্পীদের কণ্ঠস্বর, ‘জাগো বাহে, কোন্ঠে সবাই।’ বিভিন্ন আসরে শোনা যেত আবৃত্তি শিল্পীদের মিলিত কণ্ঠ, ‘তোমরা কার দিকে গুলি ছুঁড়ছো’ ‘নামাও বন্দুক’ ‘এসো মিলি সমতার পবিত্র বিশ্বাসে।’ নৃত্যের তালে তালে শোনা যেতো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ‘এই শিকল পড়া ছল মোদের এই শিকল পড়া ছল’। হাটে-মাঠে-ঘাটে-বাঁকে সোচ্চার ছিল শিল্পীদের কণ্ঠ আর শিল্পকর্ম। সেই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবদান কতোটুকুই-বা ছিল। যা করেছে এই শিল্পীরাই। এদের জন্যেই না পাবনায় মৌলবাদ, স্বৈরাচার আর শোষণ-শাসনবিরোধী বিস্ফোরন্মুখ অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এরাই মানুষকে সচেতন করে আন্দোলনে নামিয়েছিল। শিল্পী হয়েও এরা সামরিক আইন ও জরুরি আইন ভেঙেছিল, জেলে গিয়েছিল।
দশ.
এরমধ্যে ঈদটাও পার হয়ে গেছে। এক সময় এ দিনটা ছিল অকল্পনীয় আনন্দের। সে ছোটবেলার কথা। বড় হবার পর আর ওসব নেই। সব কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। বয়সী মানুষদের এটা একটা বড় সমস্যা। আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু ভাবটা দেখাতে হয় কতো আনন্দের দিন! আসলে ঈদের আনন্দ বড়দের নয়, ছোটদের। ওরা এদিন স্বাধীনভাবে ঘুরবে, বেড়াবে, আড্ডা দেবে। বড়রা নামাজটা পড়ে এসে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে একটু যাবেন। নয়তো ঘরে বসে তাস খেলে বা টিভি দেখে কাটাবেন। নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম একটা মসজিদে। মাঠেই বেশী লোক যায়। কিন্তু খালু যান মসজিদে। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাকেও যেতে হয়েছিল। খালা একটা দারুণ পাঞ্জাবি প্রেজেন্ট করেছিলেন। সেটা পরেছিলাম। সঙ্গে সুষম ছিল। খালু আবার একা আগে আগে যেতেই পছন্দ করেন। তাঁরমধ্যে একটা ‘একলা চলো রে’ ভাব আছে।
দু’জন মসজিদে গিয়ে বসার পর ইমাম সাহেবের বক্তৃতা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। তিনি যেন জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আগুনের ফুলকি ছুটছে মুখ দিয়ে। একেবারে সবকিছু ওলট-পালট করে ফেরতে চাচ্ছেন। বয়সটা কম। খুব বেশী হলে ৩০/৩৫-এর বেশী হবে না। হালকা সবুজ পাঞ্জাবি আর গাঢ নীল পাগড়ি পরে একটা সবজান্তা ভাব ফোটানোর চেষ্টা হয়েছে। দাড়িগুলো এখনও হালকা আর কাঁচা। গলায় হাজি সাহেবের রুমাল পেঁচিয়ে নিয়েছেন। হুঙ্কার দিচ্ছেন মাঝে মাঝে। তিনি যা বলছেন, সবই রাজনৈতিক বক্তব্য। মসজিদে দাঁড়িয়ে রাজনীতি! কী বিচ্ছিরি অবস্থা! বানিয়ে বানিয়ে গা জ্বলে যাওয়ার মতো অনেক কথা বলছেন ইমাম সাহেব। মুশকিল হলো প্রতিবাদ করার উপায় নেই। প্রতিবাদ করলেই নাস্তিক হয়ে যেতে হবে, না হয় ইসলামে শত্রু হয়ে যেতে হবে।
রাজনৈতিক আলোচনা করা গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মসজিদে যে রাজনীতি হয়, তার সমালোচনা করা যায় না। এখানে মওলানা সাহেব বা ইমাম সাহেব যা বলবেন- চোখ-কান বুঁজে তাই-ই শুনে যেতে হবে। সত্য বলে তাই-ই বিশ্বাস করতে হবে। হচ্ছেও তাই-ই। সবাই মাথা নিচু করে ধুম্ মেরে বসে আছেন। ইমাম সাহেবের আশে-পাশে বসা কিছু শিষ্য কেবল উত্তেজনায় ছটফট করছে। যেন এখনই তারা জেহাদে নেমে পড়তে চায়, ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে চায় ‘অনৈসলামিক’ সরকারের কাছ থেকে। নামাজ শেষ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল ইমাম সাহেবের সঙ্গে যদি নিরালায় বসতে পারতাম, মন্দ হতো না। কথা বলতাম ইমাম সাহেবের সঙ্গে-
- স্লামালেকুম ইমাম সাহেব। কেমন আছেন?
- ওয়ালাইকুম অস সালাম অ রহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু। ভাল আছি। আসুন আসুন। বসুন।
- আপনার কাছে একটু এলেম নিতে আসলাম। মানে, ঈদের জামাতে আপনি অনেক কথা বললেন তো। সেইগুলো একটু বুঝতে চাই।
- নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। মারহাবা, মারহাবা। এলেম দানের জন্যই তো আমরা। বলুন বলুন, কি বুঝতে চান?
- আপনার বক্তৃতা শুনে একেবারে আপসেট হয়ে পড়েছি। খুব উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
- মাশাহ আল্লাহ মাশাহ আল্লাহ। উত্তেজিত হতেই হবে। আমার বক্তৃতা সাকসেসফুল বলতে হবে। মাশাহ আল্লাহ।
- আমার জানা দরকার, আপনারা কি চান?
- আলহাম্দু লিল্লাহ। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সবারই জানা দরকার আমরা কি চাই। আমরা চাই ইসলামী শাসন। মানে হলো গিয়ে আল্লাহর শাসন। আল্লাহর শাসন ছাড়া মানুষের শান্তি নাই, বুঝলেন নাহ্। কোন শান্তি নাই।
- তার মানে বলতে চাচ্ছেন, এখন আল্লাহর শাসন নাই। আপনারা সেই শাসন কায়েম করবেন।
- ঠিক। ঠিক ধরেছেন। আমাদের নবীরা ছিলেন, কী সুন্দর তাঁরা আল্লাহর আইন দিয়ে দেশ চালিয়েছেন। কতো শান্তি ছিল তখন।
- তাহলে বলতে চাচ্ছেন, আপনারা নবীজির দায়িত্ব পালন করছেন?
- আলবৎ। এ দায়িত্ব পালন করতেই হবে।
- কিন্তু, নবীজিরা আয়েশে জীবন-যাপন করতেন না। একেবারে গরীবানা হালে চলতেন। পেটপুরে খেতেনও না। পাড়া-প্রতিবেশী বা খোদার বান্দারা অভূক্ত থাকলে নবীজি নিজের খাবার তাদের তুলে দিতেন। নিজে পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধা চেপে রাখতেন। তাঁরা রাজপুরীর মতো অট্টালিকায় থাকতেন না, এয়ারকন্ডিশন গাড়িতে চড়তেন না। কখনও দামি পোশাক পড়তেন না। খেজুর পাতার ভাঙা মসজিদে নামাজ পড়তেন। বিলাসিতা, জাক-জমক তাঁরা নিষিদ্ধ করে গেছেন। আপনারা কিন্তু এসব কিছুই মানছেন না।
- হে হে ভাই সাহেব। তখন তো গাড়ি-ঘোড়া-দালান-কোঠা ছিল না।
- তাহলে কি বলতে চান যে- তখন দালান-কোঠা-গাড়ি-বাড়ি-টাকা-পয়সা থাকলে সেগুলো নবীজিরা ভোগ করতেন?
- নাউজুবিল্লাহ্। তা কেন হবে? তওবা তওবা। তাঁরা ছিলেন মহাপুরুষ।
- আপনারও তো সেই দায়িত্ব পালনের কথা বলছেন।
- না ভাই সাহেব। তেনারা মহাপুরুষ ছিলেন। আমরা তেনাদের অনুসারী মাত্র।
- কিন্তু তা হলে তো তাঁদেরই অনুসরণ করতে হবে। লোভ-লালসা-আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে হবে। এসিকার-মাইক্রোবাসে ঘুরে বেড়ানো যাবে না। কাওকে অভূক্ত রেখে নিজে খাওয়া চলবে না। রাজার হালে নাদুস-নুদুস থাকা চলবে না। একেবারে গরীবানা হালে চলতে হবে। কোন শত্রু যদি এক গালে এক থাপ্পড় মারে, তাহলে আরেক গাল এগিয়ে দিতে হবে আরও থাপ্পড় মারার জন্য।
- জ্বি। কথাটা অবশ্য ফেলে দিবার নয়।
- আপনারা কিন্তু সবকিছু উল্টো করছেন। মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটছেন, খুন করছেন, সন্ত্রাস করছেন, কাওকে অমুসলিম ঘোষণা করছেন, কারও ফাঁসি দিতে চাচ্ছেন। আপনারা কেমন করে শান্তি আনবেন বলুন?
- জ্বে ভাইসাব, আমি কিছু ঠাঁহর করতে পারতাছি না।
- আমরা বলি ইসলাম হলো শ্রেষ্ঠ ধর্ম। কারণ এই ধর্ম সবচেয়ে মহৎ, মহানুভব, উদার। এক গালে থাপ্পড় খেয়ে আরেক গাল পেতে নবীজিরা শত্রুদের অভিভূত করেছেন। তাই শত্রুরা মহত্ত্বের পেছনে ছুটে এসেছে, আত্মসমর্পণ করেছে। ইসলাম গ্রহণ করেছে। আজ কি এই মহত্ত্ব ধরে রাখতে পেরেছেন আপনারা?
- জ্বি, আপনার প্রশ্নের মাজেজা আছে, বুঝতে পারতাছি।
- বরং ইসলামের নামে যা হচ্ছে, তাতে মানুষ আতঙ্কিত। মহত্ত্বই ইসলাম। কিন্তু আজ সেটা নাই। আছে উল্টোটা।
আমার কথা-বার্তায় ইমাম সাহেব একেবারে কিংকর্তব্য বিমূঢ হয়ে পড়েছেন। কী জবাব দেবেন হাতড়ে পাচ্ছেন না। কেমন যেন উসখুস করছেন।
- আচ্ছা ইমাম সাহেব, আপনি তো মোনাজাতের সময় শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের মঙ্গল কামনা করলেন। মুসলমানদের আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, আরসব সম্প্রদায়ের মানুষকেও নিশ্চয়ই অন্য কেও সৃষ্টি করেনি?
- সবই এক আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন ভাই সাহেব।
- হ্যাঁ, এক জায়গা থেকেই মানবজাতির সৃষ্টি। আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম-হাওয়া। তাই মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। সবাই সবার ভাই। তাহলে মানবজাতির মঙ্গল কামনা না করে আপনি যে মুসলমানদের মঙ্গল কামনা করেছেন, সেইটা ঠিক হয় নাই। কি বলেন?
- জ্বি, ভুল বুঝতে পারতাছি। কামডা ঠিক হয় নাই।
- তাছাড়া, আপনার মোনাজাতে আরেকটা ভুল ছিল। আপনি শুধু আপনার দলের লোকদেরই মুসলমান বলে স্বীকার করেছেন। বলেছেন, যারা জেহাদ করবে তারাই মুসলমান। অর্থাৎ যারা আপনার দলে নাই, তারা মুসলমান না। কে মুসলমান, কে মুসলমান নয়, কে ভাল, কে মন্দ, খোদার প্রিয় মানুষ কে- এইটা তো আপনার আমার জানার কথা নয়। এই বিচারের ভারও খোদা আপনাকে বা আমাকে দেননি, না কী মনে করেন?
- একেবারে খাঁটি কথা। সত্য কথা ভাই সাহেব।
- আপনি জেহাদের কথা বলেছেন। কার বিরুদ্ধে জেহাদ করছেন? মানুষ হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে তো আপনি জেহাদ করতে পারেন না। অমানুষের বিরুদ্ধে করতে পারেন, আর পারেন নিজের ভিতরের পাপের বিরুদ্ধে। কে মানুষ আর কে অমানুষ- এইটা তো জানতে পারেন শুধু খোদা। আপনি নয়।
- ঠিক, ভাই সাহেব। ভাই সাহেব, আপনি জ্ঞানী মানুষ। আমি আগে বুঝি নাই।
- কখনও নয়। আমি মোটেও জ্ঞানী নই ইমাম সাহেব। আপনার কাছ থেকে কিছু জানার জন্যই আমার আসা। যাক গে। এখন কাজের কথায় আসা যাক। আপনি তো রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কেন বলুন তো?
- না মানে, সেইটা বলছিলাম অন্য কারণে। মানে, আমাদের দেশের বেশীরভাগ মানুষ মুসলমান তো, তাই।
- মুসলমান বেশী হলেই ধর্মীয়রাষ্ট্র করতে হবে?
- আমি সেইটাই বলছিলাম আর কি।
- তাহলে ভারতের ব্যাপারে কি বলবেন? সেখানে তো হিন্দু সম্প্রদায় বেশী।
- জ্বি, বুঝতে পারলাম না ঠিক।
- মানে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্রধর্ম হয়, তাহলে ভারতকে নিশ্চয়ই হিন্দুরাষ্ট্র করতে হবে।
- জ্বি, ভাইসাব। যুক্তির কথা।
- তাহলে তো ভারতের হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি, শিবসেনা, আরএসএস দলের দাবির সঙ্গে আপনার বা আপনার দলীয় দাবির মিল আছে। না কি?
- জ্বি, তাই তো দেখা যাইতেছে।
- ইমাম সাহেব, তাই যদি হয়- তাহলে যে দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায় বেশী, সে দেশকে খ্রিস্টানরাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে। যে দেশে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বেশী, সে দেশকে বৌদ্ধরাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে। যে দেশে ইহুদি সম্প্রদায় বেশী, সে দেশকে ইহুদিরাষ্ট্র করতে হবে। নয় কি?
- জ্বি, হিসাবের কথা।
- হাহ্ হা! এর ফল কি হবে জানেন?
- কি?
- সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন। দমন। অধিকার হরণ। আর সেইজন্যই কিন্তু খ্রিস্টান মৌলবাদীরা ব্লাসফেমি আইন চায়। তাদের দেখাদেখি আপনারাও ব্লাসফেমি চেয়ে ফেললেন। মৌলবাদে মৌলবাদে দারুণ মিল, তাই না ইমাম সাহেব?
- জ্বি, ভাই সাহেব। মাথা আমার খতম ভাই সাহেব। একবারে খতম। এতোকিছু বুঝি নাই।
- ইমাম সাহেব?
- জ্বি।
- ধর্ম এক জিনিস, আর রাষ্ট্র আরেক জিনিস। ধর্মটা ব্যক্তিগত, সম্পূর্ণ নিজের জন্য। আর রাষ্ট্র সবার জন্য, সব ধর্মের সব জাতির মানুষের জন্য। সেটাকে হতে হবে নিরপেক্ষ। রাষ্ট্র কারও পক্ষের হয়ে গেলে সেখানে অন্যরা অধিকার হারাবেন। হামলা-নির্যাতনের শিকার হবেন। তাই নয় কি?
ইমাম সাহেব ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়লেন। মাথাটা তার একেবারে বুকের সঙ্গে ঠেকে গেছে। আফসোস করার মতো এদিক ওদিক সেটা মাঝে মাঝে নাড়াচ্ছেন।
- ইমাম সাহেব?
- জ্বি। -চমকে উঠলেন তিনি।
- আপনি কি একটা গান শুনেছেন? ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা। আমায় একজন কালো মানুষ দাও, যার রক্ত কালো। যদি দিতে পারো, প্রতিদান যা কিছু চাও, হোক অমূল্য পেতে পারো -----। উত্তর মেরু হতে দক্ষিণ মেরু যতো মানুষ আছে, পশ্চিম হতে ওই পূর্ব দিগন্তে যতো মানুষ আছে- একই রক্ত মাংসে গড়া, প্রেম-প্রীতিতে হƒদয় ভরা। সেই মানুষে কেনো তোমরা ভিন্ন করো, ভেদাভেদ সৃষ্টি করো? ------- জন্ম হতে ওই মৃত্যুবধি তুমি হিসাব করো, এই পৃথিবীর ধর্ম যতো তুমি বিচার করো, দেখবে সেথায় একই কথা, ঊর্ধ্বে সবার মানবতা, সেই কথাটাই বলে সবাই বড়াই করো, আবার কেনো লড়াই করো?’ শুনেছেন এটা?
- জ্বি, শুনেছি।
- কথাগুলো বুঝেছেন?
- অল্প অল্প। আপনি যদি আরেকটু খন্ডন করেন, তবে ভাল হয়।
- শিল্পী বলছেন, সব ধর্মের কথাই মানবতা আর শান্তি। আপনিও তো ঈদের জামাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু এমন একটা দেশ দেখাতে পারবেন কি- যেখানে শান্তি এনেছেন? কি, পারবেন দেখাতে?
- আমার জানা নাই ভাই সাহেব।
- দেখাতে পারবেন না। আফগানিস্তানে শান্তির কথা বলেই আপনাদের মুজাহিদরা ক্ষমতা দখল করেছিল। কিন্তু শান্তি আসেনি। বরং শান্তির বদলে আইয়ামে জাহেলিয়াত কায়েম হয়েছে। পাকিস্তানে শান্তি আসেনি। করাচীতে শিয়া আর সুন্নি মুসলমানরা পরস্পরের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে, মসজিদে গুলি-বোমা চালাচ্ছে। আলজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়, ইরান, মিশর, তুরস্ক, সৌদি আরব সবখানে মুসলমান-মুসলমান হানাহানি তো আছেই। অথচ সবাই শান্তির কথা বলে, মহত্ত্বের কথা বলে। আমাদের ধর্মেও যেমন হানাহানি নিষিদ্ধ, অন্য ধর্মের কথাও তাই-ই। অথচ সব চলছে উল্টো ভাবে।
- একেবারে খাস কথা ভাই সাহেব। কোথাও শান্তি নাই। কোথাও শান্তি নাই।
- শান্তিটা নষ্ট করেছেন আপনারা, বুঝলেন? আপনারা সহজ-সরল মানুষের মাথায় এমন বীজ ঢুকাচ্ছেন যে তারা বেহেস্ত পাওয়ার জন্য মানুষ খুন থেকে শুরু করে যতো রকম পৈশাচিক কাজ আছে, সবই করছে। অথবা সব করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অবশ্য এর গোড়াটা অন্যখানে, বুঝলেন? একেবারে অন্যখানে।
- কোথায় ভাই সাহেব? একেবারে খোলাশা কইরা দ্যান।
- আচ্ছা, আপনি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কেন বলুন তো?
- না, মানে উনারা খোদা-টোদা মানেন না তো, তাই। মানে নাস্তিক আর কি।
- একটা মানুষের আস্তিক হতেও বাধা নেই, নাস্তিক হতেও বাধা নেই। আর কে খোদা মানেন, কে খোদা মানেন না- সেটা আপনারা জানলেন কেমন করে?
- না মানে, উনারাই স্বীকার করেন তো তাই।
- ওনারা কি আপনার কাছে স্বীকার করেছেন, না খোদার কাছে স্বীকার করেছেন? খোদাই বেশী জানেন, না আপনি মানুষ হয়ে বেশী জানেন?
- না না। মানুষ হয়ে আমরা সব জানবো কেমন করে? ভাল-মন্দ সব জানেন আল্লাহ। তিনিই সর্বশক্তিমান।
- তা যদি হয়, তাহলে আপনি বিচার করবার কে? আপনি কাওকে নাস্তিক বলার কে? কাওকে খোদার শত্রু বলার কে? কাওকে অমুসলিম ঘোষণা করা বা কারও ফাঁসি চাইবার কে? আপনিই তো বলেছেন কে ভাল কে মন্দ সবই জানেন আল্লাহ। সব বিচারের মালিক তিনিই। সুতরাং খোদার ওপর খোদগারী করা কি মহাপাপ নয়?
- সত্যিই তো ভাই সাহেব। ঠিক কথা। এসব আগে একেবারেই ভাবনা-চিন্তা করি নাই।
- ইমাম সাহেব?
- জ্বি, জ্বি ভাই সাহেব।
- মানব সমাজে সত্যিকার অর্থে দুইটা ভাগ আছে। এক ভাগে আছে শোষিত মানুষ, আর এক ভাগে শোষক। আদিম যুগ থেকেই এই দুইটা শ্রেণী আছে। শোষিত মানুষের সংখ্যা বেশী, ধরতে পারেন ৯০ ভাগ। আর শোষকের সংখ্যা অল্প, ধরতে পারেন ১০ ভাগ। এই ১০ ভাগ হলো পশুশ্রেণীর। এরা ৯০ ভাগ মানুষের সম্পদ লুটে-পুটে শুষে নিয়ে বেহেস্তের মতো সুখ-শান্তি ভোগ করে। এদের জন্য বঞ্চিত মানুষেরা গোটা পৃথিবীতে বড় কষ্ট ভোগ করে, বুঝলেন?
- জ্বি।
- এই বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কমিউনিস্টরা কাজ করে। তারা শোষিত মানুষের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। পশুশ্রেণীকে উচ্ছেদ করতে চায়। আপনাদের গোড়া কোথায় শুনবেন?
- জ্বি, ভাই সাহেব।
- আপনাদের গোড়া হলো ঐ পশুশ্রেণী। ওরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য আপনাদের মাঠে নামায়। শোষিত শ্রেণীকে বিভ্রান্ত করার জন্য কাজে লাগায়। কমিউনিস্টদের সংগ্রামকে বানচাল করার জন্যই আপনারা, বুঝলেন?
- মাথা আমার শেষ বুঝলেন ভাইসাব, মাথা আমার শেষ। সেইজন্যই কমিউনিস্টদের আসল শত্রু বলছি এতোদিন। এখন বুঝতে পারতাছি। বুঝতে পারতাছি ভাইসাব, বড়লোকদের সঙ্গে কেন আমাদের নেতাদের এতো দহরম-মহরম। এখন বুঝতাছি কেন আমরা মানুষ-জনরে সবুর করতে বলি, বেহেস্তের স্বপ্ন দেখিয়ে দ্বীন-দুনিয়া থেকে দৃষ্টি ফিরাতে চাই। ধর্মকে রাজনীতিতে নিয়া আসি কেন, বুঝতাছি। ক্ষমতা দখল কইরা কার রাজত্ব ঠিক রাখতে চাই, বুঝতে পারতাছি। বুঝতে পারতাছি আমাদের নেতারা এতো রাজার হালে থাকে কেম্নে! চেহারা-সুরুৎ টকটক করে কেমনে! কী প্রতারণা, কী প্রতারণা! ছিঃ ছিঃ! গরীব মানুষগুলারে ঠকাইয়া, কেমনে আরামে থাকেরে ভাইসাব, কী সুন্দর ধর্মের কথা কয়! অথচ ধর্মের আসল কামের সাথে মিল নাই। তওবা তওবা। নাউজুবিল্লাহ্। খোদার সঙ্গে প্রতারণা!
[------ তার মুখে খই ফুটছে]
- আমি যাই ইমাম সাহেব।
- ভাইসাব আমি কি করবো বলেন, ভাইসাব বলেন আপনি। বলেন ভাইসাব, বলেন।
--------- চলবে -----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message