বুধবার, ২৩ জুন, ২০২১

স্বপ্ন রাতের তারা, আশির দশকের ধারাবাহিক গল্প (পর্ব-৯)

স্বপ্ন রাতের তারা

আবুল হোসেন খোকন

 

বারো.

বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সিদ্ধান্ত নিলামÑ কখনও মিথ্যা কথা বলি না, কিন্তু খালার কাছে মিথ্যা না বলে উপায় নেই জীবন বাঁচাতে নাকি খোদাও মিথ্যা বলাকে জায়েজ করেছেন মৌলভীরা তাই তো বলে! সুতরাং খালাকে মিথ্যা বলবো কিছু জিজ্ঞেস করলে তবে দুপুরের ব্যাপারটা জানানো যায়

বাড়িতে ঢুকতেই খালা উদ্বিগ্নভাবে জানতে চাইলেন, কোথায় গিয়েছিলাম? কে ডেকে নিয়ে গেলÑ ইত্যাদি

- মিলন ডাকতে এসেছিল

- মিলন? কোন্ মিলন?

- ওই যে, গণশিল্পীর মিলন

- এতো রাতে?

- না, মানে, দেখা করার কথা ছিল, জরুরি ব্যাপার কিন্তু হয়নি তাই এসেছিল

- আমি আর চিন্তায় পড়ে গেছি রাত-বিরাত দেশের অবস্থা ভাল নয় শহরে সমানে খুনখারাবি হচ্ছে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম

- না, না, আমার তো আর শত্রæ নেই যে ঝামেলা হবে

- আজ-কাল কি আর শত্রæ-মিত্র লাগে? কিছুই লাগে না

খালা হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যাবার মতো করে বললেন, আচ্ছা, তোমার সঙ্গে কি আলোকের (মামার) দেখা হয়েছিল?

আবার ধিক্ করে উঠলো বুকটা একেই বলে সিআইএ খালার কানে ঠিক পৌঁছে গেছে খবর কোন্ খবরটা যে পৌঁছালোÑ সেটাই কথা রাতেরটা অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছার কথা নয়

- হ্যাঁ, দেখা হয়েছিল দুপুর বেলা আমি বাসায় ফিরছিলাম, তখন সামনে এসে দাঁড়ালো

- শুনলাম, তোমরা দুজন নাকি হাসতে হাসতে যাচ্ছো? তুমি কিন্তু বলোনি

- আমি বলতে চেয়েছিলাম রাতেই বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু দেখাই হলো না আপনার সঙ্গে

- আমি কিন্তু সব খবরই রাখি কি বললো শয়তানটা?

- ওর আর বলার কি আছে? কালকে ঢাকা থেকে এসেছে একেবারে পরিবার-টরিবার নিয়েই এসেছে কোনো এক বন্ধুর বাড়ি নাকি উঠেছে

- শয়তানটার সঙ্গে কখনও কথা বলবে না আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে বদমাইশ একটা

আমি মাথা নিচু করে শুনে গেলাম খালার কথা অনেকক্ষণ তিনি প্যাঁচাল পারলেন কখনও রাগলেন, কখনও দুঃখে ভেঙে পড়লেন কান্না কান্নার মতো করে কথা বললেন কিছুক্ষণ আমি নিশ্চুপ সময় চুপ থাকাই উত্তম

 

তেরো.

সুষমটা বেশ বদলে গেছে একেবারে কথা শুনতে চায় না একদিন বলেছিলাম, আমার সঙ্গে চলো

ইচ্ছে ছিল শুচিকে কিছু খাওয়াবো মানে কোন্আইসক্রিম হোক, অথবা কনফেকশনারির ভাল কোন জিনিস হোকÑ কিনে পাঠাবো সুষম তো সঙ্গে গেলে অনেক কিছু খায়- শুচিটার জন্যই কিছু আনা হয় না তাছাড়া অনেকদিন কিনে খাওয়াই না কি যেন একটা ভাল কাজ করেছিল শুচি সেজন্য ওর প্রতি মনটা খুব ভাল ছিল এদিন খাওয়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমি বেরুচ্ছি, কখন ফিরবো ঠিক নেই রাত হয়ে যেতে পারে তখন কোন্আইসক্রিম পাওয়া যাবে না আর পাওয়া গেলেও এনে লাভ হবে না ঘুমিয়ে থাকবে সুতরাং বিকেলেই যদি সুষমকে দিয়ে কিছু পাঠাই তাহলে খেতে পারবে

সুষম যাবে না কেন যাবে, কোথায় যাবেÑ নানান প্রশ্ন ছোট মানুষ, ওকে এতো প্রশ্নের জবাব দেবো কেন! তাছাড়া কিছু কেনার ব্যাপারটা আগেভাগেই কাওকে জানাতে চাই না একেবারে কিনে, পাঠিয়ে, চমকে দেবো সুষম বলছে, ওর এখন যাওয়া সম্ভব নয়

মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল খুব রাগ হলো বললাম, কখনও তুমি আমার সঙ্গে কোথাও যাবে না আমি তোমাকে নেবো না

বললো, আচ্ছা

মেজাজটা আরও চড়ে উঠলো চেষ্টা করলাম শান্ত হবার শেষ পর্যন্ত কিছু কিনে খাওয়ানোর পরিকল্পনাটাই বাতিল হয়ে গেল

আজকালকার ছেলেরাই এরকম আর হবেই বা না কেন? পারিবারিক, সামাজিক সব ধরনের পরিবেশে রয়েছে অশুভ দিক ভবিষ্যতের জন্য সন্তান যোগ্য করে গড়ে তোলাই কঠিন আমি অবশ্য খুব সতর্ক থাকবো ব্যাপারে সন্তানদের কখনও ভয়-ভীতি প্রদর্শন করবো না, বা মারধর করবো না বন্দি করেও রাখবো না তাদের তাতে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স বৃদ্ধি পাবে, দৃষ্টিভঙ্গি পজেটিভ হবে আমার সন্তান হবে স্বাধীন এবং ফ্রাশটেশনমুক্ত এমনভাবে তাকে গড়ে তুলবো যাতে সে মানুষকে জানে, সভ্যতা আর সমাজকে বোঝে অতীত এবং বর্তমানটা তার সামনে স্পষ্ট থাকবে কোন সন্তান যদি না জানে যে মানুষ কোন্ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে পশুর স্তর থেকে মানুষের স্তরে প্রবেশ করলো, তাহলে সে নিজেকে জানবে কীভাবে? সে যদি না জানে মানুষ সভ্য হলো কেমন করে, তাহলে সে সভ্যতা সম্পর্কে জানবেই বা কি? সভ্যতার গুরুত্বই বা দেবে কি? কোন সন্তান যদি দেশ-মাটি-সংগ্রাম ইত্যাদি সব না জানেÑ তাহলে সে দেশকে ভালবাসবে কেন? অতীত না জানলে সে ভবিষ্যতের সঠিক পথ চিনবে না হাতরাতে থাকবে, অনন্ত অন্ধকারে পড়ে মারা যাবে মানুষকে সে কখনই ভালবাসবে না দেশ, জাতি মানুষের জন্য সে বোঝা হয়ে অথবা বিপদ হয়ে দাঁড়াবে

আমার সন্তানকে আমি সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন যা খুঁশি তাই করার স্বাধীনতা দেবো এইদিনে যতো অন্যায়ই করুক না কেনÑ তাকে কোনকিছু বলা হবে না, প্রশ্ন তুলবো না কখনও ধরা যাক, সপ্তাহের এই একটি দিনে আমাকে লাঠিপেটা করলো কিংবা ছুরি দিয়ে রক্তারক্তি করে দিলো তবু এটাকে মেনে নেবো, O.K. করে দেবো আসলে এই স্বাধীনতা দিয়ে দেখবোÑ আমি সন্তানকে যেভাবে মানুষ করে তুলতে চাইছি, সে সেভাবে বেড়ে উঠছে কিনা যদি আমার শিক্ষা কাজে লাগে, তাহলে স্বাধীনতা পেলে সে সন্তান আমাকে লাঠিপেটা করতে আসবে না, বা চাকু-ছুরি মেরে রক্তারক্তি করবে না প্রমাণিত হবে আমার পদ্ধতি সঠিক কিনা যদি সঠিক প্রমাণিত না হয়Ñ তাহলে আমি অবশ্যই একদিনেই যা কিছু তাই করার স্বাধীনতা থেকে শিক্ষা নিতে পারবো অর্থাৎ এই একটা দিন হবে আসলে আমার সৃষ্টি কেমন হচ্ছেÑ তা পরীক্ষা করার দিন বেশীরভাগ মানুষ তাঁদের সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিল্পপতি ধরনের কিছু বানাতে চায় আমি কখনও ওইসব বানাবো না আমি বানাবো মানুষ এজন্য কিশোর বয়সেই তাকে মাসের জন্য পাঠাবো কোন বামপন্থী আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক দলে এই মাসে সে জীবন মানুষ সম্পর্কে জানবে কৃষক, শ্রমিক, সর্বহারা মানুষের পাশে থাকবে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়সহ মানুষের শোষিত হবার বিষয়গুলো বুঝবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিপদ এবং চলার পথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবে দেশ জাতির জন্য দরকারী অনুশীলন পাবে এরপর বাকি মাস সে শহরে থাকবে উচ্চবিত্ত¡ শ্রেণীর সঙ্গে মিশবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেবে সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্বটাকে খুব ভাল করে জানবে কারণ, মানুষ হতে হলে তাকে হতে হবে রাজনীতিক মানুষের আসল সমস্যাটা রাজনৈতিক এটাই হলো সমস্যার গোড়া ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-পুলিশ-আইনজীবীসহ আরও যতো হবার মতো পথ আছেÑ ওগুলো মূল সমস্যা সমাধানের পথ নয় ওগুলোÑ গাছের শেকড়ে বা গোড়ায় সমস্যা রেখে লতা-পাতার সমস্যা মেটানোর জন্য গোড়ায় সমস্যা রেখে কি কখনও ডাল-পালার সমস্যার সমাধান করা যায়? যায় না যতোই ডাল-পালার চিকিৎসা করা হোক, অবার তা রোগাক্রান্ত হবেই তাছাড়া লতা-পাতায় চিকিৎসা করাটা আসলে ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয় এই ব্যবসায়ীরা কখনও চায় নাÑ তাদের ব্যবসা বন্ধ হোক

ধরা যাক আনজীবীদের কথা আইন অনুযায়ী বিচারকরা বিচার করেন আইনের বই থেকেই আইনজীবীরা কথা বলেন একটা মানুষ অন্য একটা মানুষকে খুন করেছে আদালতের কাঠগড়ায় আসামীকে যেতে হবে বিচারক আইনজীবীদের বক্তব্য থেকে রায় দেবেন এক পক্ষের আইনজীবী আইন অনুযায়ী প্রমাণ করবেন আসামী অপরাধী আরেক পক্ষের আইনজীবী ওই একই আইন বই অনুযায়ী আসামীকে নিরপরাধ বানানোর চষ্টা করবেন দুইপক্ষে আইরজীবী তর্কযুদ্ধ করবেন যে যতো বেশী পারদর্শী হবেন, তারই জয় হবে একই আইন থেকে যে কোন এক পক্ষের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে ধরা যাক, অপরাধী নিরপরাধ প্রমাণিত হলো অথচ সত্যি যদি অপরাধী অপরাধ করে থাকেÑ তাহলে কেন সে অপরাধী হবে না? আসামী পক্ষের আইনজীবী খুনি জানা সত্তে¡ কেন আসামীকে খুনি নয় বলবেন? অথচ এটাই বাস্তব একই আইনের বই থেকেই দুরকম জিনিস বের হয় আইনজীবীদের এটাই কাজ এই বইয়ের জন্যই তাঁদের পকেটে পয়সা আসে গাড়ি হয়, বাড়ি হয় এটা একটা জীবিকার পথ, ব্যবসা বৈ তো কিছু নয় এটা কি আইন হতে পারে? সমাজটাই রকম সত্যকে মিথ্যা বানানো হয়, মিথ্যাকে সত্য বানানো হয় এটা কি সমাজ হলো? এই সমাজ কি মানুষের কল্যাণ আনতে পারে? দেশে যদি অপরাধ না থাকে তাহলে আইনেরও দরকার নেই, পুলিশেরও দরকার নেই ভাতে-পানিতে মরতে হবে আইনজীবী পুলিশদের সুতরাং তাদের টিকে থাকতে হলে অপরাধ চাই- চাই এই সমাজ সে অপরাধ জন্ম দেয় ধিক্ এই সমাজকে

আবার রোগ-বালাই না থাকলে ডাক্তারদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠবে অনেকের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে সুতরাং তারা কেনো চাইবেন চীরতরে রোগমুক্তি? সুতরাং আমার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চাই না, আইনজীবী বানাতে চাই না আমার সন্তান হবে সমাজের গোড়া থেকে রোগ-বালাই দূর করার সৈনিক ছেলে হোক মেয়ে হোকÑ সে করবে রাজনীতি সঠিক কাজটি করার জন্য লোকের আজ বড় অভাব আমি চাইবো সে অভাব দূর হোক একটা নয়, দুইটা নয়, পাঁচটা নয়, দশটা নয়Ñ শত শত হাজার হাজার সন্তান চাই এই সন্তানেরা সুন্দর পৃথিবীর জন্য লড়বে, মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়বে তাঁরা কখনই বড়দের অসম্মান করবে না কথা শুনবে, কাজ করবে মাটি মানুষের জন্য নিজের ছোট ছোট স্বার্থের জন্য কিছুই করবে না

 

---------- চলবে ---------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message