স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
বাস যখন স্ট্যান্ডে পৌঁছালো, তখন প্রায় সাড়ে ১০টা বাজে।
শহরের একেবারে পূবে এই বাসস্ট্যান্ড। এটা আসলে স্ট্যান্ড নয়, টার্মিনাল। এটাই একমাত্র টার্মিনাল। এরশাদ আমলে এর উদ্বোধন করা হয়েছে। আগে বাসস্ট্যান্ড ছিল শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। এখন সেখানে পৌঁছাতে হলে ৫/৬ টাকা রিকশা ভাড়া দিতে হয়।
টার্মিনাল থেকে পশ্চিমে কিছুদূর যাবার পরই পড়বে মোজাহিদ ক্লাব মোড়।
এখানে রাস্তা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মেইন রাস্তাটি দক্ষিণে বাঁকা হয়ে শহরে ঢুকেছে। এ পথে যেতেই পড়বে অনন্ত সিনেমার মোড়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পৌরসভা, সদর কোর্ট, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ডিসি অফিস, পুলিশ লাইন, জেলখানা, জেলা স্কুল, টেলিফোন ভবন, বাণী সিনেমা, টাউন হল, বনমালী ইনস্টিটিউটÑ তারপর পুরনো বাসস্ট্যান্ড। এটাই শহরের কেন্দ্রবিন্দু।
মোজাহিদ ক্লাব থেকে আরেকটা রাস্তা সোজা পশ্চিম দিকে গিয়ে ইংরেজি L অক্ষরের মতো আচমকা বামে বাঁক নিয়েছে পুরনো বাসস্ট্যান্ড বরাবর। এই পথে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু নেই। আছে শুধু শহীদ বুলবুল সরকারি মহাবিদ্যালয়, আর বসবাসের বাড়ি-ঘর। এরই একটা হলো কণা খালার বাড়ি। বাড়ি বলা ঠিক নয়, বাসাবাড়ি। খালাদের নিজেদের কোন বাড়ি নেই।
তাই ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। শহরের অনেক মানুষই অবশ্য ভাড়া বাড়িতে থাকেন। গ্রাম-গঞ্জ বিভিন্ন স্থান থেকে উঠে এসে শহরে ভদ্রবেশে থাকা আর
কি! সব শহরের ব্যাপারই তাই।
অবশ্য পাবনা কিছুটা ব্যতিক্রম। রাজধানী বা অন্য শহরে যেমন বেশীরভাগ মানুষ বহিরাগত, এখানে তার উল্টো।
অধিকাংশ মানুষেরই এখানে নিজস্ব ঘর-বাড়ি আছে।
শুধু খালাদের নেই।
অধিকাংশ মানুষ কতোদিন নিজের ঘর-বাড়িতে থাকতে পারবেনÑ তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। কেননা যেভাবে হু
হু করে মানুষ বাড়ছে আর সম্পদের ভাগ অল্প কিছু মানুষের হাতে জমা হচ্ছে, তাতে খুব দ্রæতই
সাধারণ মানুষ সম্পদ হারাচ্ছে। টিকে থাকার জন্য বিক্রি করে দিচ্ছে ঘর-বাড়ি-জায়গা-জমি।
শহরটাই এখন পাল্টে যাচ্ছে। ১৫ বছর আগেও এটা ছিল একটা মান্ধাতার আমলের শহর। ইট বেরুনো ভাঙা-চোরা দালান, টিনের ঘর, খড়ের ঘর,
কাঁচা বাড়ি। এখন ওসব নেই বললেই চলে। খুব তাড়াতাড়ি গজিয়ে উঠছে আধুনিক ঝকঝকে ফ্লাট বাড়ি, প্রাইভেট মাইক্রোবাস, ট্যাক্সি, ঘরে ঘরে ডিশ এন্টেনা ইত্যাদি।
১৫ বছর আগে এসব ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তখন মানুষে মানুষে ভালবাসার সম্পর্ক ছিল কী গভীর! এখন ওসব উঠে যাচ্ছে।
মানুষ ক্রমেই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। তাই বলে গ্রামের মানুষগুলো এখনও বদলে যায়নি। সম্ভাবনাও কম। কারণ শহর যে
গতিতে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, গ্রামগুলোতে তা
হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটাই হচ্ছে। ১৫ বছর আগে গ্রামের যে দশা ছিল, আজও সেই দশাই আছে।
বরং অভাব আর
সমস্যাটা সেখানেই বেশ দ্রæতই বাড়ছে।
এখন তো বাজার অর্থনীতির যুগ, তাই এই
সুবাদে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
আর বৃহৎ সংখ্যক মানুষ সর্বহারা আরও সর্বহারা হচ্ছে। শহরগুলো চোখ ধাঁধানো হচ্ছে, গ্রামগুলো যাচ্ছে অন্ধকারে তলিয়ে। কবে যে বিশাল গ্রামের মানুষ এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে? শহর-টহর দখল করে নেবে? এ ভয়টা অবশ্য বুদ্ধিমান বড়লোকদের আছে। তাই তারা বিদ্রোহ ঠেকানোর জন্য গরীবদের দান-খয়রাত করে, গ্রামে গ্রামে মাদ্রাসা-মসজিদ বানিয়ে নিজেদের নাম টাঙিয়ে দেয়।
ধনিদের আর্শীবাদ নিয়ে সেখানে মোল্লা-মৌলভীরা যায়, মিলাদ-জালসা এইসব করে। গ্রামের গরীবদের এরা বলে- তোমরা লোভ করো না,
খোদা লোভীদের পছন্দ করেন না। ধনিদের থেকে তোমরা ৭০ বছর আগে বেহেস্তে যাবে। ধনি-গরীব সব
খোদার দান। এ নিয়ে তোমরা মাথা ঘামিও না। তোমরা খোদার শুকরিয়া আদায় করো, তার রহমত চাও, নামাজ পড়ো, রোজা রাখো, ইহকাল নয়Ñ
পরকাল নিয়ে চিন্তা করো।
এখন আবার মাথাচাড়া দিয়েছে ফতোয়াবাজরা। দুই হাতে বেশ কামিয়ে নেতা-নেত্রীর হালে চলে এরা।
এরা এখন ক্ষমতা দখল করারও স্বপ্ন দেখে।
বাস থেকে নেমে রিকশা নিলাম। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো কণা খালার বাড়ি। এই খালার বাড়িতে আছে খালা-খালু ছাড়াও দুই রত্ন শুচি আর সুষম। কাজের মেয়েও একটা আছে, নাম সালেহা খাতুন। শুচি সেভেনে পড়ে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে, আর সুষম ফাইভে পড়ে জেলা স্কুলে।
পিঠেপিঠি ভাই-বোন।
ছোট বেলায় জানতো ওরা এক বোন দুই ভাই।
বড় ভাইটা হলাম আমি। খালাই একথা প্রচার করতেন। এখন অবশ্য ওদের জ্ঞান হয়েছে, তাই সে রকম ভাবে না। জ্ঞান হওয়ার এই একটা দোষ।
সত্যটা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এই খালার বাড়িতে এক
বিশেষ টাইপের মানুষ হলো খালু। সব মানুষেরই একটা টাইপ থাকে। খালুর টাইপটা হলো ভুল থেকে কোন শিক্ষা না
নেওয়া। তিনি যে
ভুল একবার করবেন, বারবার সে ভুল করে যেতেই থাকবেন। এমনিতে তার পেশা হলো কন্ট্রাকটরি, বাংলায় ঠিকাদারি। এটা পেশা হলেও নেশা তার ঘটকালি করা। ঘটকালিতে তিনি টাকা-পয়সা নেন না। বরং বলা যায় দিয়ে থাকেন।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে অনেক লোকের কাছে তিনি মোটা টাকা পাবেন। ঠিকাদারির বেলায়ও তাই।
লোকজনের কাছে তিনি শুধু টাকাই পান।
কিন্তু কেও টাকা ফেরত দেয় না। পাওনা টাকা চাওয়ার জন্য তিনি হয়তো চলে যাবে খুলনা, যশোর, নওগাঁ। দেনাদাররা বলবে, আজ তো টাকা নাই।
হাতের অবস্থা খারাপ।
আপনি না হয় কষ্ট করে সাতদিন পর আসুন।
খালু চলে আসবেন। তারপর সাতদিন পর
যাবেন। দেনাদার তখন বলবে, টাকাটা রেখেছিলাম। এক দরকারে খরচ হয়ে গেলো। এখন যে একেবারেই অবস্থা খারাপ।
আপনি যখন এতো কষ্ট করলেনই, আর ক’টা দিন কষ্ট করুন।
একমাস পর আসুন। ইনশা আল্লাহ টাকা দিয়ে দেবো।
আপনার খুব কষ্ট হবে তাই না?
-
আরে না না, কী যে বলেন! অসুবিধা হবে না। একমাস পরই আসবো।’ বলে চলে আসবেন খালু। এদিকে হয়তো তার যাতায়াত ভাড়া নিয়ে টানাটানি।
আবার যখন তিনি একমাস পর যাবেন, তখন মাথায় হাত দিয়ে পড়বে দেনাদার, সব্বোনাশ, আপনার কথাটা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। কী লজ্জার ব্যাপার হলো! ছি: ছি:! এখন কি করি বলেন তো? একবারে পকেট খালি। কি বলি আপনাকে বলেন তো?
খালু হয়তো বলবেন, না না চিন্তা করবেন না। ব্যাপার হচ্ছে, মানে কিছুই কি
নেই আপনার কাছে?
- কিছু মানে, কি বলবো? লজ্জার কথা! পাবেন আপনি দশ
হাজার টাকা, আর পকেটে আছে মাত্র দুই/একশ’ টাকা। তাও আবার দরকার আছে।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। মানে, আপনার যদি অসুবিধা না
হয়, তাহলে কিছু টাকা দিলে ভাল হতো।’
- এই এক/দুইশ’ টাকার মধ্য থেকে দিতে বলছেন?
- জ্বি।’
- আপনি তাহলে একশ টাকা নিয়ে যান।
কিছু মনে নেবেন না। অবস্থা খুব খারাপ বুঝলেন না। ব্যবসা নাই, বাণিজ্য নাই। চারদিকে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। আমার ভাই খুব সমস্যায় দিন যাচ্ছে।
আপনি টাকা পাবেন।
খুব লজ্জার কথা! এতো কষ্ট দিলাম।
ভাই সাহেব, আর কয়টা দিন কষ্ট করেন। ইনশা আল্লাহ এবার আর আপনাকে ফেরত যেতে হবে না।’
- তাহলে একটা দিন-তারিখ দিন। আমি সেইদিন আসবো।’
লোকটা গভীর হিসেব-নিকেষে তলিয়ে যাবার ভান করে আঙুল নাচিয়ে এক সময় বলবে, আপনি দু’মাস পরে, মানে আজ চৈত্র মাসের সাত তারিখ। আপনি জ্যৈষ্ঠ মাসের সাত তারিখে আসেন।
ইনশা আল্লাহ এবার আপনাকে টাকা দিয়ে দেবো। আপনাকে দিতে পারলে দেনার হাত থেকে বেঁচে যাই।
আল্লাহ বলেছে, ঋণ শোধ করো। ঋণীর প্রতি আমার কোন দয়া নাই।
ভাই সাহেব, আমি ঋণমুক্তি চাই। খুব কষ্ট দিলাম ভাই সাহেব, খুব কষ্ট দিলাম।
খালু চলে আসবেন। তারপর শুধু দুই মাস নয়, বছরের পর বছর ঘুরেও টাকা পাবেন না। বরং নিজের হাতে টাকা থাকলে সেগুলোও এলাকায় কারও কাছে ঋণ দেবেন। ঘটকালির সময় টাকা দেবেন। নিজে ফতুর হয়ে ঘরে ফিরবেন।
কণা খালার এজন্য খুব চিন্তা খালুকে নিয়ে। কারণ এমন হলে তো সংসার চলবে না। খালা নিজে যদি স্কুলে শিক্ষকতা না করতেন, তাহলে গোল্লায় যেতো সব
কিছু।
এমন একটা দিন ছিল যখন খালাতো ভাই-বোন দুটি আমার জন্য অস্থির হয়ে থাকতো। আমাকে ছাড়া থাকতেই পারতো না। বিশেষ করে শুচিটার কথা বলা যেতে পারে। ছোট বেলায় আমার ঘাড়ে চড়ে বেড়াতো।
হইচই হইহুল্লোর বাঁধিয়ে যা-তা অবস্থা করতো।
দাওয়াত করে যদি কখনও বাড়িতে আত্মীয়- স্বজনদের খাওয়ানো হতো, তখন বারবার বলতো, সবাই এলো, ভাইয়া এলো না! আম্মা, ভাইয়া কি
আসবে না? ভাইয়াকে আসতে বলোনি?
খালাকে অতিষ্ট করে তুলতো।
পথ চেয়ে চেয়ে দেখতোÑ আসি কি
না। খালার বাড়িতে যেদিন আসতাম সেদিন উৎসবের বন্যা বয়ে যেতো। অথচ সেইদিন আর নেই। এখন সেই শুচির মনোভাব বোঝা যাবে না। আমি এলে আনন্দ বা অসন্তুষ্টÑ কোন ভাবই টের পাওয়া যাবে না। সেজন্য বেশ জটিল মনে হয়
ওকে। বড় হয়েছেÑ এটাই হয়তো কারণ। তাছাড়া নিজেকে ও হয়তো একটু বেশী বড় ভাবা শুরু করেছে, অহঙ্কারও জন্ম নিয়েছে।
ওকে সুষ্পষ্টভাবে জানতে হলে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারি। কিন্তু করবো না। কারণ সেটা হবে একেবারেই কারও ব্যক্তিগত পর্যায়ে নাক গলানো।
ব্যক্তিগত এবং গোপন ব্যাপারগুলোর ওপর নজরদারি একটা অপরাধও। তাই চাই না
ওসব জানতে। না থাক আগের ভালবাসা।
সুষমটাও একই। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। শুধু খালাটাই আপন আছেন। তিনি না থাকলে এ বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কই হয়তো চুকেবুকে যেতো। তিনি ভালবাসেন মায়ের মতো।
নিজের সন্তান থেকে একচুলও কমতি নেই এ ভালবাসায়। মানুষ তো
মানুষকেই ভালবাসবে। পশু তো
আর মানুষকে ভালবাসে না। ভালবাসার জন্যই তো
দুনিয়া। সমাজটা ভালবাসাকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু যেসব মানুষ লেবাস পরে থাকে, তারাই ভালবাসা নষ্ট করে। আমার কথা হলোÑ যে আমাকে ভালবাসবে, আমিও তাকে ভালবাসবো। সে যেই হোক না
কেন। স্বয়ং ঈশ্বর হলেও একই কথা।
রিকশা থেকে বাড়ির সামনে নামলাম। গেটের কলিং বেলের বোতাম টিপে বুঝলাম নষ্ট। সে-ই একবার আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম, তারপর আর
সাড়া হয়নি। খট্খট্ শব্দ হতেই সালেহা ছুটে এলো।
তালা খুলে দিলো।
খালা কিছু একটা করছিলেন। উঠে এলেন।
মুখটা খুঁশিতে ভরে উঠলো। ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। টেবিলে রেখে সোফায় বসলাম।
- কখন রওনা দিয়েছো?
- ভোরে। সাতটারও আগে।’
- নিশ্চয়ই খাওনি? এই সালেহাÑ, শিগগির হাত-মুখ ধুয়ে এসো।’ এদিকে সালেহা উঁকি দিয়ে বললো, কি?
- খাবারগুলো গরম কর
তাড়াতাড়ি। বের কর। আমি আসছি।
- খালাম্মা, ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি নাস্তা করে এসেছি’Ñ বললাম আমি।
হাত-মুখ ধুতে বাথরুমে ঢুকলাম। পানি মুখে লাগাতেই ভাল লাগলো।
বেরিয়ে এসে যখন বসলাম তখন দারুণ আরাম বোধ হলো।
খালা এরইমধ্যে খাবারের আয়োজন করতে গেছেন। আপার বাড়ি আর
খালার বাড়ি এই
একই অবস্থা। তাঁরা আমাকে খাইয়েই যেন শেষ করে ফেলতে চান। শুচিকে এক নজর দেখলাম, কেমন আছোরে শুচি?
- ভাল।
- ভাল কি রকম?
- ভালর আবার রকম আছে নাকি? তুমি কেমন আছো?
- ওই একই রকম, ভাল। ও হ্যাঁ, এই জিনিসগুলো ধরোতো।
ব্যাগ থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা বের করে দিলাম।
তারপর আরও দু’টো প্যাকেট বের করলাম। একটায় সুষমের সার্ট, আর একটায় শুচির সালোয়ার-কামিজ। কয়েক দিন আগে মার্কেট থেকে ঘুরে ঘুরে কিনেছিলাম। এই জিনিস কিনতেই আমার তিনদিন লেগেছিল।
খুঁজে খুঁজে পছন্দসই কিছুই পাচ্ছিলাম না।
শুচি ওগুলো উল্টে-পাল্টে দেখলো, শুধু শুধু কিনতে গ্যাছো কেন?
তারপর চলে গেল আর
কোন মন্তব্য না
করে। ভাল-মন্দ কিছুই বললো না। কিন্তু আগের দিনে হলে খুঁশিতে লাফিয়ে অস্থির হয়ে যেতো। সব সময় কাছে কাছে রেখে সবাইকে দেখাতো, আমার ভাইয়া দিয়েছে এগুলো।
ও ভিতরে চলে গেল।
খালা খাবারের থালা-বাসন-ডিশ নিয়ে ঢুকলেন।
জামা-কাপড় দেখে হাসলেন।
- আমিতো এসব কিনিনি কখনও। একেবারেই অভ্যাস নেই।
মেয়েদের কোন জিনিস এই প্রথম কিনলাম।
কী কিনবোÑ ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে শুচি আর
সুষমের জামা-ই
কেনা হয়ে গেল।
এখন গায়ে ফিটিং হয় কিনাÑ সেটাই কথাÑ আমি বললাম।
খাবার নামিয়ে রেখে খালা দেখতে লাগলেন জামাগুলো।
এরমধ্যে শুচি ঢুকলো, কতো দিয়ে কিনেছো ভাইয়া?
বিনু-বুনুকে যদি নিক্সন মার্কেট থেকেও একেবারে জঘন্য কিছু কিনে দিতাম, তবু কেও কখনও দাম জিজ্ঞেস করতো না। কারণ উপহারের সঙ্গে দামের কোন সম্পর্ক নেই। যতো কম
দামই হোক না
কেনÑ ওদের কাছে তা হতো মহামূল্যবান সম্পদ।
- কতো মনে হয়,
বলো? পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি। শুচির সেট হাতে নিয়ে জবাব দিলেন খালা,
- ছয় শ’র কম তো হবে না।
- ছয় শ’ই চেয়েছিল। আমি আগেই শুনেছিলাম, দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ চেয়ে থাকে।
আমি শ তিনেক বলেছিলাম। সাড়ে তিনশ’ তে দিয়ে দিয়েছে।
- খুব ভাল হয়েছে।
একেবারে কমে পেয়ে গেছো। এখানে পাঁচ-ছয়শ’র কমে পাওয়া যাবে না।’ শুচির মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না।
- সুষমটারই কম দাম। মাত্র পৌণে দু-শ। সুষম কোথায় দেখছি না যে?
- ওর কথা! খেলতে গ্যাছে। স্কুল ছুটি।
তোমার খালু নাই।’
- খালু কোথায়?
- যশোর গেছে। টাকা চাওয়ার জন্য।
- ও। একদিন পর
তো ঈদ! আসবেন না?
- কি জানি! কী যে করবেÑ বুঝতে পারছি না। ঠিকমতো বলেও যায়নি কিছু।
আমাকে খেতে দেওয়া হয়েছে মাছ, ভাত, ডাল আর পোলাও। বললাম, পোলাও কেন?
মায়ের মতো হাসলেন খালা, কাল রান্না করেছিলাম।
লোকজন এসেছিল। বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অন্য খালাদের কথা, খালাতো ভাই-বোনদের কথা জানতে চাইলাম। খালা সবার কাহিনী বলতে লাগলেন। এক খলাতো ভাই নিয়ে খুব দুঃখ করলেন। সে এক মহা অন্যায় কাজ করে ফেলেছে।
খালা তার বিস্তারিত শোনালেন। অন্যায়ের জন্য দায়ী করলেন ছোট মামাকে।
এই মামা ছিল খালার খুব প্রিয়। কিন্তু সে কাওকে না জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে। এখানেই খালার রাগ।
শুধু রাগ নয়,
ছোট মামা এখন খালার সবচেয়ে বড়
শত্রæ। আত্মীয়-স্বজন যে
কেও কোন ভুল বা অন্যায় করলে তাতে তিনি মামার হাত খুঁজে পান।
বেচারা মামা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকুক না থাকুক, সে আসামী হবেই।
খালা আসলে ঝড়-ঝাপ্টাকে সহ্য করতে পারেন না। একেবারেই ভেঙে পড়েন।
মানুষের জীবনটাই তো
ঝড়-ঝাপ্টা সামলাবার জন্য। ঝড় মানুষের জীবনেই আসে।
একবার নয় অনেকবার আসে। সে ঝড় বেশীরভাগ সময়েই সব
কিছু ধ্বংস করে দিতে চায়। এই সত্যটাকে স্বীকার করে নিয়ে যদি তা
মোকাবেলার জন্য সদা প্রস্তুত থাকা যায়Ñ তাহলেই ঝড় ঠেকানো যায়। সমুদ্রের জলোচ্ছাস ঠেকাবার জন্য যেমন আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা হয়, এরকম মানুষের জীবনের জলোচ্ছাস-ঘুর্ণিঝড় ঠেকাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। যে তা না থাকেÑ সে ধ্বংস হয়ে যায়।
খালার এই উপলব্ধিটার যথেষ্ট অভাব।
তার কথা হলোÑ সব সুন্দর, সুষ্ঠু আর নির্ঞ্ঝাটভাবে চলবে। আসলে সব মানুষই তাই ভাবে।
কিন্তু বাস্তবটা বড় নির্মম। খালার সব
কাহিনী শুনতে শুনতে দুপুর হয়ে গেল।
ভেবেছিলাম শহরে বেরুবো।
কিন্তু এ বেলা আর হবে না। একটু আরাম করে, ঘুমিয়ে-টুমিয়ে বিকেলে বেরুতে হবে।
------- চলবে -------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message