স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
উনিশ.
আমি এখন বগুড়ায়। কোথাও বেশীদিন থাকা হয় না, যেহেতু পাখির মতো মানুষ যাযাবর। তাছাড়া চলার শেষ না হলে স্থির হওয়াটাই বা যায় কিভাবে? তবে ব্যতিক্রম হলো এখানে অনেক দিন আছি।
বগুড়ার বৈশিষ্ট হলো, অত্যন্ত সমৃদ্ধ এলাকা। বলা যায় সুপারসনিক গতিতে এখানকার মানুষ নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। ঢাকার পরেই এখানকার স্থান। তবে সরকার এখনও বগুড়ার উপযুক্ত মর্যাদা দেয়নি। বিভাগ ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন চলছে। টিভি সেন্টার, ভার্সিটিসহ আরও কিছু ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য বার বার দাবি তোলা হচ্ছে। কিন্তু সরকার তার কিছুই মানছে না। মন্ত্রীরা এসব দাবি মেনে নিয়ে যাচ্ছেনÑ আর বগুড়া ছাড়তে না ছাড়তেই সব ভুলে যাচ্ছেন। মিথ্যা ওয়াদা দিয়ে শুধু ভোটের বাক্স ভারী করার চেষ্টা চলছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বগুড়া এগিয়ে গেলেও ঢাকার মতো এখানকার মানুষের মন এখনও যান্ত্রিক হয়ে যায়নি। এখনও তাদের অন্তর আছে সহজ, সরল, ভালবাসায় পরিপূর্ণ। যদিও ফ্যাশান আর আচার-আচরণের দিক দিয়ে মেয়েরা ফার্স্ট হবার একটা ভান করে থাকে। কিন্তু নিজের মধ্যে দুর্বলতা থাকলে যে কোন অহংবোধের যা পরিণাম হয়, এখানকার অবস্থাও তাই। ধরা খেয়ে যায়।
রাস্তা-ঘাট ও দালান-কোঠাগুলো তেমন ভাল নয়। বিভাগ হিসেবে রাজশাহী থেকে এটাই তফাৎ। এখানে বেড়ানোর মতো জায়গা হিসেবে আছে মহাস্থানগড়। ঐতিহাসিক স্থান। কাছেই গোকুল। সেখানে আছে বেহুলা-লক্ষিন্দরের বাসরঘর। আর শহরে আছে একটা পৌর উদ্যান। আরও আছে কারুপল্লী নামে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কেন্দ্র। এখানে আছে কৃত্তিম আজবগুহা, আদিম মানুষ, পাহাড়, বন, বাঘ, ভালুক, হাতি, ঘোড়া, সাপ, বানর, কুমির, ডাইনোসরসহ বহু কিছু। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক এগুলো বিনা পয়সায় দেখার সুযোগ পায়। অথচ ৫/১০ টাকা করে টিকেট সিস্টেম করলেও এখানে লোক হতো। ঢাকা হলে তাই-ই করা হতো। এখানকার মুনষ যে যান্ত্রিক আর লোভী হয়নিÑ এটাও তার প্রমাণ।
হাঁটছি। চায়ের নেশা পেয়েছে। সাতমাথা থেকে থানার দিকে যেতে হবে। ‘এশিয়া’ নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। এখানে চা, মিষ্টি আর সিঙারা বা সমুচা পাওয়া যায়। আর কিছু নেই। কিন্তু লোকজন মিষ্টি বা সিঙারা খেতে আসে না। রেস্টুরেন্টটাতে সবাই আসে চা পান করতে। বলা যায় চায়ের জন্য বিখ্যাত এটা। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এখানে ভিড় লেগেই থাকে। বেশিরভাগ সময়ই বসার সিট পাওয়া যায় না। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে খেতে হয়। এশিয়া’য় চায়ের বৈশিষ্ট হলো- খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি করা চা। দারুণ স্বাদ। যদিও আস্তে আস্তে মান কমে যাচ্ছে, তবু দূর-দূরান্ত থেকে এখানেই ছুটে আসে লোকজন।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভাগ্য ভাল, ২/১ টা সিট ফাঁকা আছে। ছয় সিটের এক টেবিলের দুই পাশে দুই সিট ফাঁকা। ফাঁকাটা কোণায় হলে ভাল হতো। লোকগুলো মাঝখানে ফাঁকা রেখে বসেছে। চা পানে ব্যস্ত একজনকে সরিয়ে ভেতরে ঢোকা একটা ঝামেলার ব্যাপার। লোকটাকে রিকোয়েস্ট করতে হবে, তারপর লোকটা ঠোঁট থেকে কাপ নামিয়ে রাখবে, ঠাং জোড়া একদিকে বাঁকা করবে, জায়গা হবেÑ সেখান দিয়ে ঢুকতে হবে সিটে। এতোসব করার পর যখন বসলাম, তখন সামনের আসনেও একজন ঢুকে বসে পড়লো। লোকটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ হলো, কালো চশমায় চোখ ঢেকে রাখার ব্যাপারটা। ভীতু শ্রেণীর লোকেরাই কালো চশমা বা রঙিন চশমা পেেড়। এরা আসলে নিজেদের দুর্বলতাকে চাপা রাখার জন্য চোখ ঢেকে রাখে। চোখ হলো একটা ইন্দ্রিয়, যেখানে নিজের স্বরূপটা থাকে। ওইখান দিয়েই ইচ্ছে করলে অন্য কেও ভেতরটায় ঢুকে পড়ে দেখে ফেলতে পারে। তাই আজকাল মাস্তান, সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত আর নানা অপকর্মের হোতারা গাঢ় রঙিন চশমা পড়ে। চশমা পড়ে নিজেকে তারা স্মার্ট আর গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে জাহির করতে চায়। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া এই চলটা ঘটিয়ে গেছেন।
আজকাল মওলানা গোছের দাড়িওয়ালা অনেক যুবকও এই চশমা পড়া শুরু করেছে। এরা নিজেদের আড়াল করার জন্য এতো ব্যস্ত কেনÑ তা অনেকেই বোঝে না। অবশ্য এরা যে রাজনৈতিক দল করে, সেই দলের রুই-কাতলারা কালো চশমা পড়ে না, সাদা চশমাই পড়ে। যেমন গোলাম আযম। তার সাদা চশমা পড়ার কারণ হলো, কালো চশমা পড়ে তার আর নিজেকে লুকিয়ে রাখার কিছু নেই। বাংলাদেশের জন্মের আগে-পরে থেকে এখন পর্যন্ত তার কীর্তিকলাপের কথা লোকজন জানে। কাজেই সে সাদা চশমা পড়ে। তার ডান-বামরাও তাই করে। কিন্তু এই তরুণ যুবকদের ব্যাপারটা তো আর লোকজন জানেনা, তাই তাদের কালো চশমা পড়তে হয়। চশমার মতো আরও কতো কি আবরণ পড়ে নিজেকে রেখে-ঢেকে রাখতে হয়। না হলে, ওদের একেবারে পিটুনি খেয়ে লাশ হয়ে যেতে হবে।
আমার সামনে বসা যুবকটার মুখে দাঁড়ি নেই, পাঞ্জাবি বা আলখেল্লাও পড়া নেই। হয়তো সে অন্য লাইনের। হোক না কেন যা খুঁশি তাই। আমি চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। ‘আমি যা করছি তা কেও দেখেনি’Ñ এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল স্কুল জীবনে। আমাদের ক্লাসে লালু নামে এক ছেলে ছিল। আমরা তাকে গুন্ডা বলে জানতাম। কিন্তু লালু যতোই গুন্ডা হোক, আমাদের ক্লাসের স্যার ছিলেন গুন্ডার বাবা। প্রপিতামহ বলা চলে। যেমন রাগ তেমন ভয়ঙ্কর চেহারা। আমাদের যখন পিটুনি দেওয়া শুরু করেন, তখন একেবারে লাশ বানিয়ে ফেলেন। কাজেই লালুর মতো ছেলেও তাকে দেখে কাপড় নষ্ট করে ফেলার মতো হয়ে যায়। এই লালু একদিন রাস্তার ধারে এক দোকানে বসে ধুমসে সিগারেট টানছে। হঠাৎ দেখে কাশেম স্যার আসছেন। আসছেন মানে কি, একেবারে এসে পড়েছেন। সিগারেট খাওয়া দেখলে আর আস্ত রাখবেন না। লালু মহাবিপদে পড়ে গেল। ফেলে দিলেও স্যার দেখে ফেলবেন, না ফেললেও দেখবেন। শেষে ফট্ করে লালুর মাথায় বুদ্ধি এলো চোখ বন্ধ করে থাকার। চোখ বন্ধ করে থাকলে যেহেতু সে নিজে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, সেহেতু স্যার দেখবেন কেমন করে? এই ভেবে সিগারেট হাতে নিয়ে লালু অনেকক্ষণ চোখ বুঁজে বসেছিল, অর্থাৎ যতোক্ষণ না স্যার চলে যেতে সময় লাগে ততোক্ষণ। আজকালকার চশমা ওয়ালাদেরও ব্যাপারটা তাই। চশমা পড়ে ওরা মনে করে কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
----------- চলবে ----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message