স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
কুড়ি.
আমার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এটা হলো মূল পরিকল্পনা। আপার বাড়ি গিয়েই এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো হবে। তাছাড়া আন-আফিসিয়াল একটা পরিকল্পনা আছে। শীঘ্রই বিনুদের কাছে চিঠি লিখবো। পরিকল্পনার কথাটা জানাতে হবে। তবে মূল পরিকল্পনাটা আগেই ফাঁস করা হবে না। এটা আপার বাড়িতে পৌঁছার পরই প্রকাশ করা হবে। সুতরাং এটার ব্যাপার আপাতত স্টপ। বিনুদের শুধু জানানো হবে আন-অফিসিয়াল পরিকল্পনাটা। এটা হলো মূল পরিকল্পনা বহির্ভূত। এরসঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকবে না তার। এই পরিকল্পনায় আছে ক্যাসেট, ক্যামেরা ইত্যাদি তৈরি রাখার। খাতা-কলম প্রস্তুত রাখার। আরও টুকিটাকি অনেক কিছু আছে, যা মূল পরিকল্পনার পাশাপাশি চালানো হবে।
এদিকে একটা সমস্যা হয়ে গেছে। এর আগে বিনু-বুনুদের কাছে লেখা চিঠির পর এক মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু কোন জবাব পাইনি। এমন হবার কথা নয়। বিনুর ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হতেও আর ৪/৫দিন বাকি। কেমন পড়াশুনা হয়েছে, সমস্যা আছে কিনাÑ ইত্যাদি জানিয়ে লেখার কথা। বুনুর টুকিটাকি অনেক কথা জমা হয়, সেগুলো জানানোর কথা। সর্বময় অবস্থা জানিয়ে লিখবেন আপা। তাও লেখেননি। মোট কথা হঠাৎ করে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এটা একেবারে ভয়ঙ্কর রকমের অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই মনটা খারাপ এবং টেনশনে ভুগতে হচ্ছে। একটা অভিমানও চেপে বসছে। সমস্যাটা আরও প্রকট আকার ধারণ করলে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। আমি যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, তা মিস্ হবার উপায় নেই। কারণ এডিসহ রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠিয়েছিলাম। এডি ফিরেও এসেছে যথাসময়ে। বিনু তাতে সই করেছে। সুতরাং চিঠি পায়নিÑ এমন ঘটনা ঘটেনি। তাহলে কি হতে পারে?
ওদের চিঠি না পাওয়া পর্যন্ত আমিও লিখতে পারছি না। বুঝতে পারছি অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু এতো দূর থেকে এ ক্ষমতা প্রয়োগ খুব কঠিন। রেজাল্ট ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সাধু-সন্নাসীরাই সঠিক রেজাল্ট পেতে পারে। কারণ তারা ব্যাপারটা নিয়ে সব সময় চর্চার মধ্যে থাকে। আমার তো সে সুযোগ নেই। তারপর যদিওবা ক্ষমতা খাটাই, তাতে একটা নির্দিষ্ট সীমার বেশি অতিক্রম করতে পারবো না। আপারা সবাই কি করছেন দেখতে পাবো, কিন্তু কি ভাবছেন তা জানতে পারবো না। এটা জানতে হলে সামনা-সামনি চোখাচোখি হতে হয়। আমি তো অতো ক্ষমতাধর নই যে, অনেক অনেক দূর থেকে দিব্বি একজনের ভিতরে ঢুকে যেতে যাবো। তবুও যতোটুকু দেখা পাওয়া যায়, ততোটুকু থেকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে জানতে হবে।
একবার তো বুনু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা লাভের জন্য ধরে বসেছিল। কিছুটা শিখিয়েও ছিলাম। সেদিন আমি, আপা আর বুনু ভোর রাতে বেরিয়েছিলাম প্রকৃতি দেখতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আধো অন্ধকারে তিনজন চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর। অনেক বাড়ি-ঘর, রেল লাইনের ধার, ক্ষেত পেরিয়ে পৌঁছেছিলাম ফাঁকা মাঠে। কুয়াশার সকাল দারুণ। তার ওপর পূব আকাশ থেকে সূর্য উঠবে বলে ক্রমেই সাদা হয়ে উঠছিল। আপা তাঁর শাড়িতে একেবারে ঘাসের শীষ, শিশির ইত্যাদি জড়িয়ে একাকার করে ফেলেছিলেন। আমার আর বুনুর অবশ্য অতো মাখামাখি হয়নি। আমার প্যান্ট আর আর বুনুর পাজামায় সামান্য করে লেগেছিল শিশির এবং ঘাসের উঁকুন।
সেই ভোররাতে বেড়াতে বেড়াতে বুনু বলেছিল, মামা, আপনি কথা দিয়েছিলেন, সূর্যের কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহের ব্যাপারটা শেখাবেন।
- হ্যাঁ, বলেছিলাম। এখন ভাল সময়। আচ্ছা, আপাকে সামনের দিকে চলে যেতে দাও। তারপর শুরু করবো।
আপা এমনিতেই অনেক এগিয়ে গেছেন। আমরা ধীরে হাঁটতেই তিনি বেশ দূর চলে গেলেন।
- বুনু?
- বলেন মামা।
- মহাশক্তি বলে একটা কথা আছে। সেটা হলো সূর্য।
- কেমন করে?
- পৃথিবীসহ যতো গ্রহ-উপগ্রহ আছে, সব সূর্য থেকে সৃষ্টি। সূর্য একটা আগুনের পিন্ড। বি-শাÑল, অনেক অনেক মহা বিশাল। এই পিন্ড থেকে ছোট্ট কণা খসে খসে পৃথিবী, মঙ্গল গ্রহ, শুক্র গ্রহ, শনি গ্রহসহ বহু গ্রহ আর উপগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এরা সবাই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সূর্যই এদের সকল শক্তির উৎস। সূর্য তাপ দেয়, আলো দেয়। সূর্যই বাঁচিয়ে রেখেছে সকল প্রাণীকে, সকল প্রকৃতিকে। তাই সূর্য ছাড়া কারও উপায় নেই।
- সূর্য না থাকলে কী হবে?
- দুনিয়া থাকবে না। সূর্য শক্তি যোগায়। এই যোগানো একটু যদি কমিয়ে দেয়, তাহলে অনেক ওলট-পালট কান্ড ঘটে যাবে মহাকাশ থেকে শুরু করে ভূ-মন্ডলে। সুতরাং সূর্যই আমাদের শক্তি। সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্রের জীবন। এই মহাশক্তির কাছ থেকে তুমি নিজে, সরাসরি শক্তি গ্রহণ করবে। তাহলে তুমি নতুন শক্তি পাবে।
- ভয়ঙ্কর ব্যাপার মামা! ক্ষতি হয়ে যাবে নাতো?
- না, খু-উ-ব সাবধানে এ শক্তি সংগ্রহ করতে হবে। একটু ভুল হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, বিরাট ক্ষতি হবে তোমার।
- উ-মা, ভয় ভয় লাগছে।
- না, ভয়ের কিছু নেই। মহাশক্তি সূর্য, ওঠারও আগে তোমাকে ঘুম থেকে জাগতে হবে। বেশ আগে উঠতে হবে।
- তারপর?
- তারপর, হাত-মুখ ধুয়ে সম্পূর্ণ পাক-পবিত্র হতে হবে।
- তারপর মামা?
- সূর্য তখনও ওঠেনি। তুমি ছাদে চলে যাবে। কেও যেন তোমাকে বিরক্ত না করে।
- তারপর?
- তারপর পূব দিকে মুখ করে, পা ভাঁজ করে ধ্যান করার মতো বসবে। পূব আকাশ ফর্সা হবে। সূর্য ওঠা শুরু করবে।
- তারপর, তারপর কি হবে?
- সূর্যটা যখন উঠতে থাকবে, তখন একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। কোনভাবেও চোখের পলক ফেলা যাবে না। দেখবে খুব দ্রæত জেগে উঠছে সূর্য। জ্বল্জ্বল্, চক্চক্, ঘুরছে। তুমি সূর্যের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। একেবারে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে। মনে মনে বলবে, আমি সূর্যের শক্তি গ্রহণ করছি। আমার মধ্যে চলে আসছে সূর্যের তেজষী শক্তি।
- কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকবো?
- প্রথম দিন এক মিনিট। বেশি পারবে না। চোখের পলক পড়ে যেতে পারে। তাছাড়া বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। আগে অভ্যস্ত হতে হবে।
- চোখের পলক যদি এক মিনিটের আগেই পড়ে যায়?
- না, তা যাবে না। পলক না পড়ার জন্য অন্য সময় অনুশীলন করবে। এম্নি কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এই অনুশীলন করতে হবে। তারপর সূর্যশক্তি গ্রহণে নামতে হবে।
- এক মিনিট হয়ে গেলে চলে আসবো?
- না, আস্তে করে চোখ বন্ধ করে, ডানে বা বাঁয়ে তাকাবে। ডানে-বাঁয়ে অবশ্যই সবুজ গাছ-পালা বা প্রকৃতির দৃশ্য থাকতে হবে। চোখ খুলবে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে। আরও এক মিনিট তাকিয়ে থেকে চোখের পাতা বন্ধ করবে আর খুলবে। দ্রæত।
- এটা কেন করতে হবে?
- কারণ সূর্য থেকে প্রকৃতিতে ফিরে আসতে হলে এই সাধনার প্রয়োজন। এতে চোখ ভাল থাকবে, দৃষ্টি তীক্ষè হবে। তাছাড়া তোমাকে প্রথম দিন যেমন এক মিনিট, দ্বিতীয় দিন আরও এক মিনিট বা আধা মিনিট সময় বাড়াতে হবে। এভাবে দু’ঘণ্টা পর্যন্ত যেদিন তাকিয়ে থাকতে পারবে, সেদিন তুমি পূর্ণ শক্তি সঞ্চয় করবে। কিন্তু সূর্য ওঠা থেকে দু’ঘণ্টা পর্যন্ত কী তেজ হবে ভেবেছো? তখন যদি সবুজের সঙ্গে চোখ মেলাতে না পারো, তাহলে তো অন্ধ হয়ে যাবে।
- তাহলে আমাকে প্রতিদিন আধ মিনিট বা এক মিনিট করে করে সময় বাড়াতে হবে। সবুজ দৃশ্যের দিকেও কি ওইভাবে সময় বাড়াতে হবে?
- অবশ্যই।
- দু’ঘণ্টা পর্যন্ত সাধনা শেষ হলে কি হবে? আমার শক্তি কেমন হবে?
- সে তখনই বুঝতে পারবে। তোমার মস্তিষ্ক এবং চোখের শক্তি শত শত গুণ বেড়ে যাবে। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা পাবে। চোখ দিয়ে তুমি অনেক কিছুই করতে পারবে। কাওকে যদি ভয় দেখাতে চাও, তার দিকে তাকালেই সে জ্ঞান হারাবে। চোখের শক্তি দিয়ে তুমি আগুন জ্বালাতে পারবে। ধরো, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আক্রমণ করার জন্য আসছে। তুমি তার চোখে চোখ রাখতে পারলে বাঘ অন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা তার চোখ ফেঁটে যাবে। অবশ্য তুমি যেটা চাইবে সেটাই হবে। আরও কতো অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারবে, সেসব এখন বলবো না। আস্তে আস্তে বলবো।
- মামা, আপনার কি দু’ঘণ্টা প্রাকটিস করা আছে?
- না, নেই। ৪/৫ মিনিট পর্যন্ত করা আছে।
- আর করেননি কেন?
- সময় কোথায়? সময় থাকলে কতো কিছু করতাম!
এরমধ্যে আপা চলে এসে বললেন, কি ব্যাপার তোমরা পিছিয়ে পড়ছো কেন? চলো চলো আরেকটু ঘুরে আসি। দেখ দেখ কী সুন্দর দৃশ্য সব। অ্যা-ত্তো ভাল লাগছে!
--------- চলবে ----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message