স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
একুশ.
রাত। Extra sensory perception-এ যাচ্ছি। এ জন্য ধ্যানে বসেছি। এর আগে বিকেলে একবার E.S.P. তে যেতে হয়েছিল। আপাদের কোন খবর পাচ্ছি না কেনÑ সেটা জানার চেষ্টাই ছিল মূল লক্ষ্য। তখন বিনু পড়ছিল। আপা শুয়ে ছিলেন। আর বিনু ছবি আঁকছিল। আসল খবরটা কিছুই জানতে পারিনি। সব স্বাভাবিক দেখেছি। শুধু দুলাভাইকে দেখা যায়নি।
এখন দ্বিতীয় দফা অতীন্দ্রিয় পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য সমস্ত জানালা-কবাট বন্ধ করা। রাত বলে তেমন কোন সাড়া-শব্দ নেই কোথাও। শুধু শ শ শব্দে মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, আর বাইরে থেকে মাঝে মাঝে গুরু-গম্ভীর গাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। অনেক দূরের শব্দ বলে আসুবিধা নেই। পাক-পবিত্র হয়ে মেঝেতে বসেছি। আসনে চলে গিয়ে দু’হাত হাঁটুর ওপর মেলে দিলাম। আমাকে এখন বিটা থেকে আলফা লেভেলের দিকে আসতে হবে। চোখ বন্ধ করলাম। ধীরে নিঃশ্বাসটা ছাড়ছি। মনি দু’টোকে ২০ ডিগ্রি উঁচুতে নিয়ে এলাম। মনে মনে তিন গুনলাম। এক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে দুই, তারপর এক। সব শেষে জিরোতে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে আলফা লেভেলে পৌঁছে গেলাম। তারপর আরও নিচে। ব্রেন ওয়েভ সম্পূর্ণ শিথিল হয়ে গেছে। হাতের মধ্যমা, তর্জনী আর বৃদ্ধ আঙুল আপনা-আপনি একসঙ্গে মিলে গেছে। এবার নিজের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছি।
এলাম। দেহ থেকে বের হয়ে ওপরে ভাসলাম। নিজের ধ্যানমগ্ন শরীরটাকে দেখলাম। মূর্তির মতো বসা। ঘরের এদিক ওদিক লক্ষ্য করলাম। সব ঠিক আছে। আস্তে করে বাতাসে ভেসে বের হয়ে এলাম রুমের বাইরে। তারপর বাড়ির বাইরে। আরও খানিকটা ওপরে উঠে বাড়িটাকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম। নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমিয়ে।
এবার যাত্রার জন্য তৈরি হলাম। সাঁ সাঁ করে বেশ খানিকটা আকাশের দিকে উঠে গেলাম। নিচে অন্ধকার শহর। তারার মতো ইলেকট্রিক বাতিগুলো মিট মিট করছে। হঠাৎ হঠাৎ নাইটকোচ জাতীয় গাড়িগুলোর হেড লাইট ঝিলিক দিচ্ছে। জমাট শহরটাকে ফেলে ঠান্ডা বাতাসে ভর করে ছুটলাম আপাদের বাড়ি।
১০ সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে গেলাম টার্গেটে। বাড়ির চারদিক ভাল করে লক্ষ্য করলাম। দালানের ভেণ্টিলেটার দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। তার মানে ভিতরে জেগে আছে। এবার ভিতরে ঢোকার দরজায় দাঁড়ালাম। ভিতর থেকে এঁটে বন্ধ করা। কিন্তু আমার অসুবিধা নেই। ইচ্ছে করা মাত্রই ভিতরে ঢুকে পড়লাম। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে মেঝে থেকে ওপরে ভাসছি। হ্যাঁ, বিনু টেবিলে গর গর করে পড়া মুখস্ত করছে। আর বুনু কি একটা গল্পের বই পড়ছে বিছানায় উপুর হয়ে। আপাদের ঘর অন্ধকার। নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। না ঘুমালেও শুয়ে আছেন। অন্ধকার থাকলেও অসুবিধা নেই। ইচ্ছে করলেই আমি দেখতে পাবো। কিন্তু ইচ্ছে নেই। আমার জানা দরকার কেন চিঠি-পত্র দিচ্ছে না কেও। এটা সঠিকভাবে জানতে হলে মনের ভিতরে ঢোকা দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার অতো ক্ষমতা নেই। আমার দেহটা রয়ে গেছে বগুড়া। আমার আত্মাটা শুধু আপাদের বাড়িতে এসেছে। আত্মা সরাসরি মনের ভিতরে ঢোকার ক্ষমতা রাখে না। যারা বেশি এক্সপার্ট তারাই কেবল বেশি ক্ষমতা রাখে। আমার শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন ক্ষমতা নেই।
আমার আত্মাকে কেও দেখতে পাচ্ছে না। আমি চিৎকার করলেও কেও শুনতে পাবে না। অপেক্ষা করছি কেও এমন কোন কথা বলে কিনাÑ যা থেকে অনুমান করা যায়, কেন চিঠি লেখেনি? অপেক্ষা করে চলেছি। বিনু-বুনু একইভাবে বই পড়ে চলেছে। কোন কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও আধঘণ্টা খানেক হাওয়ায় ভেসে বেড়ালাম। রান্নাঘর, খাবার ঘরে ঘুর ঘুর করলাম। বিনু-বুনুদের ঘরে আবার ঢুকলাম। কোন পরিবর্তন নেই। মহা মুশকিল হলো! ওদিকে ধ্যানমগ্ন দেহটাকে বেশীক্ষণ বসিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তাতে দেহের ক্ষতি হতে পারে। আর কিছুক্ষণ ঘুর ঘুর করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম।
ধ্যানমগ্ন দেহটায় স্যাঁৎ করে ঢুকে পড়লাম। জিরো, এক, দুই, তিন, চার গুনে পাঁচ-এ পৌঁছালাম। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে গেল। এক হয়ে থাকা আঙুলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আসন ভেঙে ফেললাম। কোন কিছু উদ্ধার করতে না পেরে অস্থিরতা বেড়ে গেল। কেন লিখছে না চিঠি? কী কারণ থাকতে পারে? এখন একটা মূল্যায়ন প্রয়োজন। চিঠি না দেওয়ার একটা কারণ হতে পারে যে- বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়া। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেল সব স্বাভাবিক আছে। সুতরাং কোন দুর্ঘটনার ব্যাপার ঘটেনি। তারপর কারণ থাকতে পারে, সময়ের অভাব বা ভুলে যাওয়ার ঘটনা। এর আগেও সময়ের অভাবে লিখতে দেরী করা হয়েছে, কিন্তু এতো দীর্ঘ নয়। তাই এটাকেও পুরোপুরি গ্রহণ করা যাচ্ছে না। ভুলে যাবার ব্যাপারটা আগে যেভাবে ঘটেছে, তা হলোÑ চিঠি যথাসময়ে লিখে খামে ভরে রেখে দেওয়া হয়েছে। কাউকে হয়তো পোস্ট করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সে দায়িত্ব পালন করেনি। তারপর সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু সেটাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুতরাং ভুলে যাবার ব্যাপারটাকেও পুরোপুরি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া আমি যেখানে যাবো, সেখানে বিশেষ একটা গুরুত্ব থাকবার কথা। এবারে অন্তত ভুল হতে পারে না। এছাড়া আরও যে সব কারণ থাকতে পারে তারমধ্যে পারিবারিক কলহের ঘটনা থাকতে পারে। যেমন চিঠি লেখা নিয়ে বিনু, বুনু বা আপার মধ্যে কথা কাটাকাটি হলো, তারপর রাগারাগি করেÑ চিঠি দেবো নাÑ এমন একটা ব্যাপার হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই দারুণ মন খারাপ হবার কথা। কিন্তু অতীন্দ্রিয় পর্যবেক্ষণে সে ধরনের কিছু পাওয়া যায়নি। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে যে, হয়তো চিঠিটা ওরা যথা সময়েই পাঠিয়েছে, কিন্তু ডাক বিভাগের কেরামতিতে ওই চিঠি পৌঁছেনি। হারিয়ে গেছে। এরকম ঘটনা দু’বার ঘটেছে। ওরা হয়তো চিঠি পাঠিয়ে আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা করছে, উল্টো এদিকে আমি ওদের চিঠির অপেক্ষা করছি। এই ব্যাপারটা দ্রæত জানা খুব কঠিন। তবে এক্ষেত্রে চিরকূট পাঠিয়ে সংকেত দেওয়া যেতে পারে।
আমার একটা বড় সুবিধা হলো, মাত্র ১৫ পয়সায় চিরকূট পাঠাতে পারি। আমি যে অফিসে চাকরি করি, সেখান থেকে ১৫ পয়সার ডাক টিকেটে পত্রিকা পাঠানো হয় বিভিন্ন জায়গায়। আমি শুধু ওদের ঠিকানায় পাঠানো পত্রিকার মধ্যে একটি চিরকূট পাঠিয়ে দিলেই হলো। পেয়ে যাবে। সুতরাংÑ যাহা সিদ্ধান্ত তাহা পালনীয়। চিরকূট পাঠিয়ে চিঠি দিলাম প্রথমে বুনুর নামে। কারণ বিনু পরীক্ষার কারণে ব্যস্ত। ওকে লিখতে বাধ্য করা ঠিক হবে না। তারপর আপাও সংসার নিয়ে দিনরাত দৌঁড়ে বেড়ান। সময় একেবারেই পান না। কাজেই তাঁকেও দায়িত্বে ফেলা যাবে না। দুলাভাইয়ের ব্যাপার তো আলাদা। তিনি কখনও কাওকে চিঠি লেখেন না। তার উপর তিনি অন্য জায়গায় বদলী হয়েছেন। ক’দিন পর পর বাড়ি ফেরেন কে জানে! সুতরাং বুনুই হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য টার্গেট।
চিরকূট পাঠনোর পর দেড় সপ্তাহ কেটে গেল। অথচ এক সপ্তাহের মধ্যেই উত্তর দেবার জন্য বলা হয়েছিল। ডাক ব্যবস্থার বদৌলতে এটাও মার গেল কিনাÑ কে বলবে? আবার চিরকূট লিখলাম। এবার বাধ্য হয়ে বিনু’র কাছে। মাত্র তির লাইনের কথায় অভিমান জাতীয় আক্রমনটা গুরুত্ব পেল।
সাত দিন কেটে গেল। এটারও কোন উত্তর নেই। অদ্ভুৎ ব্যাপার! এরকম হলে তো আপার বাড়ি যাওয়াই বাতিল হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত কি সমস্ত পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাচ্ছে?
--------- চলবে -------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message