আবুল হোসেন খোকন
বাইশ.
কিশোর কবি সুকান্ত একটা বাসযোগ্য পৃথিবী’র কথা বলেছিলেন। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। সে নিজেও বাঁচতে পারেনি, বাসযোগ্য পৃথিবীও হয়নি। স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে সামান্য কিছু মানুষ। তাদের কারণে পৃথিবী ভিত, সন্ত্রস্ত। পরমাণু অস্ত্রগুলো হামলা করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। অস্ত্র আর সেনা ছাউনিগুলো তাদের দখলে। সমাজ পরিচালনার নামে তারা এক ভয়ঙ্কর কারাগার তৈরি করেছে আমাদের চারপাশে। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ পরিস্কার করে বলে গেছেন এসব কথা।
সভ্যতার শীর্ষস্তরে উঠেও মানুষ তাই অনাহারে মারা যায়। কাপড়ের অভাবে লজ্জা ঢাকতে পারে না। বাসস্থান নেই, রোগে-শোকে চিকিৎসা নেই। অসংখ্য মানুষের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে যেমন সামান্য কিছু মানুষ, তেমনই ছোট ছোট অনেক দেশের ওপর ছড়ি ঘেরাচ্ছে শক্তিধর কয়েকটি দেশ। সামান্য কিছু মানুষ আর সামান্য ক’টি দেশের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ক্ষমতার জোরে সবার ভাগ লুটেপুটে খাওয়াই তাদের ধর্ম। তাদের ধর্মের জালবিস্তারে সৃষ্টি করা হয়েছে নানা জীব-জন্তু।
এক ধরনের জীব-জন্তু আমাদের দেশে বেশ লম্ফ-ঝম্ফ শুরু করেছে। এরা ৫২ থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত মানুষের স্বপ্নকে পিষে মারতে চেয়েছে, ৭১ সালে নেকড়ে আর হায়েনার মতো মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু মানুষের মিলিত শক্তির কাছে অসভ্য জীব-জন্তুরা টিকতে পারেনি। তারা পরাজিত হয়েছে। অবশ্য হাল ছেড়ে দেয়নি তারা। এখন আবার প্রকৃতির শ্যামলীমাময় অরণ্যকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য মাঠে নেমেছে। শ্বাপদের মতো সবুজকে রক্তাক্ত করে তুলছে। দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাতকাটা-রগকাটা শুরু করেছে। রূপমদের মতো প্রতিদিন হত্যা করছে তাজা নিষ্পাপ প্রাণকে। দেশের সব জায়গায় জোর করে ওরা সভা-সমাবেশ করছে। সরকার আর পুলিশ ওদের রক্ষা করছে। বলছে, জীব-জন্তুকে বাঁচাতে হবে।
দেশে এক নতুন যুদ্ধের অবস্থা তৈরি হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তাদেরকে ওরা খতম করে দিচ্ছে। যারা সমর্থন করেছিল তাদেরকে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ গড়ার পক্ষে ছিল বলে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে হত্যার হুমকী দিচ্ছে। ক’দিন আগে কবি শামসুর রাহমানকে ওরা সিলেটে অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। কবির অপরাধ তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন। একটা স্বাধীন দেশে আজ স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রকাশ্য বিচরণ!
পরিস্থিতি ক্রমেই যেন তাঁতিয়ে উঠছে। আরেকটা যুদ্ধ যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। যুদ্ধটাই হয়তো বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার পথ। জন্তুগুলো কী অদ্ভুৎ! এই বগুড়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে ওরা হিংস্র দাঁত-নখর বের করে ছোবল মেরেছিল সাতমাথার ভাস্কর্যের উপর। শান্তি আর সুন্দরের পায়রা হাতে, রাইফেল কাঁধে ভাস্কর্য। ওরা সেটা ভেঙে ফেলেছিল দিনের বেলা হাজারো মানুষের সামনে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে প্রায় মেরে ফেলেছিল। পরে হাসপাতালে নেবার পর বেঁচে যায় সে। কী আশ্চর্য, এই জন্তুরা পরদিন প্রচার করলো মুক্তিযোদ্ধারাই নাকি ভাস্কর্য ভেঙেছে! ওরা মসজিদে, ধর্ম প্রতিষ্ঠানে এসব বললো। কিছু লোক তা বিশ্বাসও করলো। চোখের সামনে মিথ্যাচার! অথচ কিছু লোক কেমন অন্ধ! একেই বলে মানুষ যখন জন্তু হয়ে যায়, তখন সে আর মানুষ থাকে না। অথচ জন্তু থেকে মানুষ হলে, সে মানুষই হয়।
এদের জন্য বুনু’র একটা স্বপ্নও পূরণ হবে না। বুনু একদিন তার চাওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিল-- এমন একটা জায়গা চাই, যেখানে যতো খুঁশি আনন্দে চিৎকার করবো, কেও বলার থাকবে না। লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে বেড়াবো, কেও বাঁধা দেবে না।’ আমি মনে মনে বলেছিলাম-- এমন একটা অবস্থা চাই যেখানে রাজা থাকবে না, শাসন থাকবে না, শোষণ থাকবে না, পুলিশ-মিলিটারি থাকবে না। থাকবে শুধু মানুষ। মানুষ থাকবে মানুষের জন্য।’
অথচ জন্তুগুলোর কারণে তা হতে পারছে না। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ’র কথাই ঠিক- একদা অরণ্যে যেভাবে অতিকায় বন্য প্রাণী হত্যা করে আমরা অরণ্য জীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি, আজ এইসব অতিকায় কদাকার বন্য মানুষগুলো নির্মূল করে আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো।’
তেইশ.
ঈদের ঠিক ১৩ দিন আগে হঠাৎ বিনু’র চিঠি এলো। সুন্দর একটা চিঠি। কিন্তু অদ্ভুৎ কান্ড হলোÑ চিঠিটা লেখা ২৪ দিন আগে। আসতে এতোদিন লাগার কথা নয়। সাধারণত দু’দিন লাগে। না হয় সেখানে চারদিন লাগতে পারে। ঘটনাটা কি বোঝা খুব কঠিন। ২৪ দিন আগে বিনু’র পরীক্ষা শুরু হয়নি, মাত্র ৭ দিন আগে শুরু হয়েছে। সুতরাং এ চিঠিতে সর্বশেষ অবস্থা নেই। পরীক্ষার জন্য কেমন মরণ-পণ পড়াশুনা করছেÑ চিঠিতে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ এসেছে। সব ভালবাসা, আশা-ভরসা গুঁড়িয়ে যাবেÑ এমন একটা হতাশার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
একটা কবিতার বই বেরিয়েছে বিনু’র। সেটা পড়ার পর কোন্ কবিতাটা ভাল লেগেছেÑ তা জানতে চেয়েছে। শুধুমাত্র একটা কবিতার নাম বলতে হবে। ওর ভালোলাগার সঙ্গে মেলে কিনা, যাচাই করবে। সবশেষে বলেছে, যতো ব্যস্তই থাকি উত্তরটা যেন বড় হয়।
বসতে হলো উত্তর লিখতে। তিনটা চিঠি লিখলাম। বিনুকে লিখলাম- হারিয়ে গেছি’ কবিতাটি পছন্দ করেছি। অবশ্য সবগুলোই ভাল হয়েছে, কিন্তু একটার নাম দিতে হলো। উত্তরে জানিয়ে দিলাম, চারদিনের মধ্যে আমার চিঠির উত্তর চাই। না হলে ছুটিতে যাওয়ার ব্যাপারটা ভেস্তে যেতে পারে। আপা আর বুনু’র কাছে একই ইঙ্গিত দিলাম। এক কথা- ৪ঠা মে-র মধ্যে জবাব চাই। জবাব পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি আরেকটি চিঠি দেবো। তাতে থাকবে আমার রোমাঞ্চকর পরিকল্পনা। যা ছুটিতে গিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে।
চিঠি তিনটি নিয়ে পোস্ট অফিসে গেলাম। জি.ই.পি. তে পোস্ট করলাম। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে। চিঠি পৌঁছাতে চারদিন লেগে গেলে জবাবও যথা সময়ে পাবো না, আমার পাল্টা জবাব দেবার সুযোগ থাকবে না। চিঠি পোস্ট করার পর শুরু হলো অপেক্ষার পালা। যথা সময়ে যদি চিঠি আসে তাহলে পরিকল্পনামত সব হবে। আর তা না হলে সমস্ত কিছু ওলোট-পালোট হয়ে যাবে। আমার খুব জেদÑ বলে একটা পরিচিতি আছে। আসলেও হয়তো তাই। যা বলেছি, তা অক্ষরে অক্ষরে হতে হবে। না হলে গোলমাল শুরু হবে। এরকম গোলমালে অনেকজনের সঙ্গে সম্পর্কই নষ্ট বা শেষ হয়ে গেছে। আর জেদ আছে বলেই তো ঘরে ফেলা হয়নি। হয়নি স্বপ্ন রাতের তারায় পৌঁছানো।
চব্বিশ.
তিনদিন পর অবাক কান্ড। যা কল্পনাও করিনি তাই ঘটলো। ৪ তারিখে চিঠি পাবার আশা করেছিলাম। কিন্তু ২ তারিখেই তা এসে গেল। এটা ক্ষুণাক্ষরেও ভাবিনি। চমৎকার তিনিট চিঠি। যদিও আপার চিঠি সংক্ষিপ্ত। আমি অবশ্য সংক্ষিপ্তই চেয়েছিলাম। দুই ভাগ্নিই ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে।
আপা লিখেছেন, আমরা ভাল আছি। তোমার ভাগ্নি মোটামুটি পরীক্ষা দিচ্ছে। মন ভাল থাকে না ভাই। সব সময় ঝামেলা। দুইটার সময় পত্র পেলাম তোমার, তখন আরডি থেকে লোক এসে মাপ-ঝোক করেছে। কেস চলছে কোর্টে। তাছাড়া অন্যান্য ঝামেলা আছে। তোমার পত্রের উত্তর ভালভাবে দিতে চাই, পারি না। শারিকদের কাছেও পত্র দেওয়া হয় নাই। ওদের অবস্থাও তোমার মতো। ভাল থেকো, সুস্থ থেকো ভাই। ৯ তারিখে পরীক্ষা শেষ। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। বেশী পরিমাণ পানি খাবে। ইতি, তোমার আপা।’ এই হলো আপার চিঠি। সংক্ষিপ্ত হলেও অনেক কিছু বুঝে নেবার মতো।
বুনুটা ঝাল-মিষ্টি দিয়ে লিখেছে। বেশ অভিমান করেছিল আমার উপর। লিখেছেÑ মামা, কিছুক্ষণ আগেই আপনার চিঠি পেলাম। চিঠি পড়েই বুঝতে পারলাম, আমি আপনাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু জানেন, আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি। আমি যে কি বোকা! আপনার সেই ছোট চিঠি পেয়ে খুব মন খারাপ করলাম। চিঠি লেখা বন্ধ করলাম। কিন্তু একবারও ভেবে দেখলাম না, অনেকেই আপনার বড় চিঠি পাওয়ার আশায় বসে থাকে, তাদেরকে একটু বড় চিঠি দিয়ে আমাকে না হয় একটু ছোটই দিলেন। সত্যি বলছি মামা, এবার থেকে একদম রাগ করবো না। যতোটুকু চিঠিই পাই না কেন, তাই আমার প্রাপ্য বলে মনে করে নেবো। মামা, আপনাকে আমি সেই প্রথমে যতোটা শ্রদ্ধা করতাম, এখনও ততোটা করি। কোনদিন এই শ্রদ্ধা নষ্ট হোক তাও আমি চাই না। আর তা ছাড়া আমি চিঠির উত্তর দেইনি, মানে আমার কাছে আপনার কোন দাম নেই, এটা মনে করার কোন কারণ নেই। আমি তো অসুস্থও থাকতে পারতাম। কিন্তু ছিলাম না। আসলে আমার চিঠি না দেয়ার প্রধান কারণ, রাগ। আর রাগ হলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। যাক বাবা, এই ভুল বোঝাবুঝির তো অবসান ঘটলো। এবার আসল কথাতে আসি। এবার ঈদ তো মামা আমাদের সাথে করছেন। কী প্রচন্ড মজা হবে, ভাবতেই আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে। আর আপনার পরিকল্পনাগুলো তাড়াতাড়ি লিখবেন। এমন পরিকল্পনা করবেন যে, বাস্তবায়ন হবে। না হলে পরি-টা উড়ে যেয়ে কল্পনা নিয়ে আমাদের বাস করতে হবে। আর খবরদার, আমাদের জন্য টেনশন করবেন না। আমারও আপনার অনেক খবর জানার ছিল।’
বুনু আরও লিখেছে। আগের চিঠিতে আমি একটা পরিকল্পনার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, ভবিষ্যতে টাকা হলে কম্পিউটার কিনবো। এই কম্পিউটারের মালিক হবো তুমি (বুনু), আমি আর বিনু। আমাদের কাজ হবে নিজেদের লেখা বই কম্পোজ করা, আর বই প্রকাশ করা। দারুণ হবে! সে ব্যাপারে বুনু লিখেছে, ‘আপনার চিন্তাটা খুব সুন্দর মামা। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে শুধু ভবিষ্যত নয়, অদূর ভবিষ্যত দরকার। কারণ, আপুর কাছ থেকে জানলাম, একটা কম্পিউটারের দাম দুই লাখের কম না। যাই হোক, বাস্তবায়ন হোক স্বপ্ন, এটাই চাই।’
বিনু’র চিঠিটাও একই রকম। ওর কথা এই রকমÑ আমার পরীক্ষা চলছে। পাঁচটা হয়ে গেছে। আগামী পরশুদিন বিজ্ঞান (১ম পত্র) পরীক্ষা। খুব টেনশনে আছি। সিট বসেছে হেলেনাবাদ স্কুলে। আমার সামনে, পেছনে এবং পাশে সব খারাপ মেয়েরা বসেছে। ওদের নকল করা দেখতে যেয়েই ভয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু ওদের কোন ভয় নেই। বোঝা যায়, ওরা পেশাদার। এছাড়া আমাদের এখানে কোন ফ্যান নেই। এই প্রচন্ড তাপে সিদ্ধ হতে হতে পরীক্ষা দিচ্ছি। মোটামুটিভাবে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষার অভিজ্ঞতা। আমার পরীক্ষা মোটামুটি হচ্ছে। দোয়া করেন যেন রেজাল্ট আশানুরুপ হয়।’
বিনু আরও লিখেছে ওর একটা বইয়ের ব্যাপারে। একটা পত্রিকায় আমিই সেটার পরিচিতি তুলে ধরেছিলাম। বিনু লিখেছেÑ আপনার পাঠানো বিশেষ পত্রিকাটা পেয়েছি। খুব ভাল লেগেছে। মনে হয়েছে, লেখাটা শুধু আমার সুনাম দিয়েই ভরা। হয়তো আপনি আমাকে ভালবাসেন বলেই আমার কোন ত্রæটি আপনার চোখে পড়েনি।’
এরপর বিনু আমাকে হকচকিয়ে দিয়ে বলেছেÑ সে যাক, আমার মনটা বড্ড অভিমানী। তাই আপনার সাথে আমার একটা পুরনো হিসাব আছে। আসলে বুঝতে পারবেন। এখানে আসলে তবেই আমার রোল নম্বর জানতে পারবেন।’
হিসাব-নিকাশটা কীসেরÑ তা ঠাহর করতে পারলাম না। কী-ই বা ভুল-টুল করে ফেলেছি, মনে নেই! এরপর বিনু শেষ পর্বে লিখেছেÑ প্রকৃতির আর সমাজের এই বাধা-ধরা পুরনো নিয়ম ভেঙে যখনই কিছু করতে ইচ্ছে করে, তখন নিজের চারদিকে দুর্ভেদ্য দেয়াল দেখতে পাই। চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে বড় অসহায় লাগে।’ এখানেই শেষ হয়নি।। এক জায়গায় জানানো হয়েছে, ৯ মে পরীক্ষা শেষ হবে। চিঠি শেষ করেও বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে নিচে লেখা হয়েছেÑ কবে আসবেন অবশ্যই জানাবেন। পরীক্ষার পর কিছুদিন ঝামেলা মুক্ত। ঈদে শারিক-সৌম্যরা আসবে। তাই কিভাবে, কয়দিন থাকবেন, বিস্তারিত জানাবেন।’
শারিক-সৌম্য হলো আমার আরেক আপার দুই সন্তান। এই ভাগ্নেদের বয়স প্রায় দুই এবং প্রায় ছয়/সাত বছর। চিঠিগুলো পাবার পর আমার সামনে আর কোন বাধা রইলো না। এখন যাবার পালা। তার আগে পরিকল্পনাটা বাস্তবায়নের জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করতে হবে।
অনেক দিন পর নিউমার্কেটে ঢুকতে হলো। কেনাকাটার ভিড় বেশ। জামা-কাপড়-কসমেটিকস আর ইমিটেশন গয়না-গাটির দোকানগুলোতে মেয়েদের প্রচন্ড ভিড়। আমিই বোধহয় একমাত্র পুরুষ ব্যক্তি। খুব কষ্ট করে কয়েকটি গহনার দোকান ঘাটলাম। শেষে পছন্দ হলো লাল আর শ্বেতপাথরের গহনা। বিনু আর বুনু’র জন্য কিনে ফেললাম। বিনু’র জন্য সাদা পাথরে আর বুনু’র জন্য লাল পাথরে কাজ করা গহনা। জীবনেও এসব কিনিনি। ওদের পছন্দ হলেই হয়। আপা আর দুলাভাইয়ের জন্য কিছু নেওয়া হচ্ছে না। কারণ শারিকরা এসে যাওয়ায় বাজেট ঠিক রাখা যাবে না। শারিক আর সৌম্যকেও কিছু দিতে হবে। সেটা হবে আপা আর দুলাভাইয়ের ভাগ বাতিল করে।
আবার ঘুরলাম গোটা মার্কেট। কি দেবো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। শেষে সুন্দর দেখে একজোড়া কলম আর বই কিনলাম শারিকের জন্য। বইটা কমিকসের। ও খুব পছন্দ করে। সৌম্য’র জন্য আপাতত এখনই কিছু নেওয়া হলো না। ওই পিচ্চি মানুষকে কি দেওয়া যায় ভাবনার বিষয়। পরে মাথায় কিছু এলে নেওয়া যাবে। এরপর ফুজি কালার ল্যাবরেটরিতে ঢুকলাম। প্রয়োজনীয় কালার্ড ফিল্ম কিনলাম। ফ্লাশ লাইটের ব্যাটারিও নেওয়া হলো। বিকেলে সাদা ক্যাসেট আর অন্যান্য সরঞ্জাম কিনলাম। অভিযান শুরু হলে এসব লাগবে। এর আগে অবশ্য আরও জিনিস-পত্র তৈরি রেখেছি। তিনদিন পর চিঠি পাঠালাম। বিনু-বুনুকে মূল পরিকল্পনাটা জানালাম না। এটা যাবার পর ফাঁস করা হবে। আন-অফিসিয়ালগুলো লিখলাম।
আজ ৬ তারিখ। জি.ই.পি. তে চিঠি পোস্ট করলাম বলে কালই পেয়ে যাবে। আমার যাওয়াটা কবে হবে সেটা চূড়ান্ত করার জন্য অফিসে আলাপ করতে হবে।
তাও হলো। লম্বা ছুটি অনুমোদিত হয়েছে। আমি যাচ্ছি ৯ তারিখ ভোরে। এদিনই বিনু’র পরীক্ষা শেষ। ওকে অবাক করে দেবো বলে ঠিক কললাম। এমনভাবে এদিন রওনা দিতে হবে, যাতে ওর পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই গিয়ে পৌঁছাই। তারপর বাস থেকে নেমে সোজা চলে যাবো হেলেনাবাদ পরীক্ষা কেন্দ্রে। রিকশা ওয়ালাকে বললে নিশ্চয়ই চিনবে। আমি চিনি না জায়গাটা। সেন্টারে পৌঁছে পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবো। তারপর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। বিনু বের হয়ে এসেই আমাকে দেখবে। শেষ পরীক্ষায় এটা ওর জন্য হবে একটা অবাক করা সারপ্রাইজ। অবশ্য পরীক্ষাটা কখনÑ তা জানিনা। হয়তো সকালে মনে করে আমি গেলাম, কিন্তু পরীক্ষাটা আসলে বিকেলে। তাহলেই সব গড়বড় হয়ে যাবে। অবশ্য মন বলছে, কোন গড়বড় হবে না। আমার মন যা বলে, তা কখনই মিথ্যা হয় না। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। সময় বসে থাকে না। গড়িয়েই যায়। গড়িয়ে গড়িয়ে সময় এসে গেল। আজ ৮ তারিখ। কাল ভোর ৬ টায় রওনা হচ্ছি।
--------- চলবে -----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message