স্বপ্ন রাতের তারা
আবুল হোসেন খোকন
পচিশ.
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। সকালে গা গরম গরম মনে হচ্ছিল। দুপুরের মধ্যে শরীরের সমস্ত কিছু গুলিয়ে এলো। ভেঙে পড়তে লাগলো দেহ। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। খানিক পরেই টের পেলাম মাথা-হাত-পা-মুখসহ শরীরে আগুন ধরে গেছে। ভিতরে যেন বিস্ফোরণ ঘটছে। সব ছিঁড়ে-ছুটে যেতে চাইছে।
দুঃস্বপ্ন দেখে বার বার জেগে উঠতে হলো। চোখ দু’টো যেন আগুনের পিন্ড। মাথা আর হাত-পায়ের ওজন হয়ে গেছে দশগুণ মতো। নাড়াতে পারছি না। কোন শক্তি নেই শরীরে। রাজ্যের জ্বর নেমে এসেছে। জ্বর হলে ব্রেন ওয়েভের সিস্টেম পাল্টে যায়। নিউরোট্রান্সমিশন উল্টা-পাল্টা হয়ে যায়। ইম্পাল্স এবং নিউরোন স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না। জিনের গঠন অনুযায়ী এন্জাইমও তৈরি হয় না। ব্রেন হ্যাল্যুশিনেশনের শিকার হয়। দুঃস্বপ্নগুলো এসে আক্রমন শুরু করে। এই অবস্থায় ঘুমটা আরামের হয়না বেশিরভাগ সময়ই। দুর্বল দেহটাকে বিছানায় ফেলে রাখা মাত্রই র্যাপিড আই মুভমেন্ট (REM) শুরু হয়ে যায়। স্বপ্ন দেখার স্তরে থাকতে হয়।
একজন ব্যক্তির মোট ঘুমের ২০ ভাগ সময় কাটে আরইএম পর্যায়ে। এটা স্বাভাবিক সময়ে। কিন্তু অসুস্থ হলে বেশিরভাগ সময়টাই আরইএম পর্যায়ে থাকতে হয়। শরীরের সমস্ত গ্রন্থিগুলো দুর্বল থাকার কারণে এ সময় শত্রæপক্ষ সুবিধা করতে পারে। এ কারণে মানুষ এ সময়েই ভয় পেয়ে থাকে। সাহসী মনও কোন কোন সময় একমাত্র অসুখের কাছেই নতি স্বীকার করে।
আমার ব্যাপারটা এতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। জ্বর যেভাবে এসেছে, সেভাবেই সেড়ে যাবে। এ নিয়ে চিন্তারও কারণ নেই, ডাক্তারের কাছেও যাবার প্রয়োজন নেই। জীবনে আমি কখনও ডাক্তারের কাছে যাইনি, ওষুধপত্রও খুব কম খেয়েছি। কেন যেন মনে হয়, ও সবের কোন দরকার নেই। রোগ আমার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। আমার বিশ্বাস আর মনোবলের কাছে ‘বাবারে মারে’ করে রোগ পালাবে। তবে রোগ আমাকে যেটুকু ক্ষতি করতে পারবে সেটা হলো, দুর্বল করে দেওয়ায়। রোগ আসবে, কিছু সময়Ñ বড়জোড় দু’একদিন ধরে চেষ্টা করবে বাসা বাঁধতে। তারপর ব্যর্থ হয়ে চলে যাবে। কিন্তু এ সময়টার মধ্যে শরীর একেবারে দুর্বল হয়ে যাবে। উঠতে বসতে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হবে। উপায় নেই। এখানে আমাকে দেখার কেউ নেই, সাহায্য করারও নেই। নিজেকে দিয়েই নিজের জন্য সব করতে হয়।
রাত। সকালের আগে জ্বর যাবে বলে মনে হয় না। অবশ্য দুপুরের চেয়ে এখন অবস্থা ভাল। সারা দুপুর দুঃস্বপ্ন দেখে কাটাতে হয়েছে। আবার শুয়ে পড়ছি। হয়তো সারা রাতই নানান স্বপ্ন দেখতে হবে। কখনও কখনও চমকে উঠতেও পারি, চিৎকারও করতে পারি। ঘুমের ঘোরে বকবক করে কথাও বলতে পারি রাতভর। তবে অসুবিধা নেই। একা থাকি বলে কেও শুনবে না। নিজের কথাগুলো অন্য কেও শুনে ফেললে সত্যিই একটা লজ্জার ব্যাপার হতো। ভাগ্যিস, সে ভয়টা নেই।
সারারাত স্বপ্ন দেখলাম। কতো রকম স্বপ্ন যে ঠিক নেই। বেশিরভাগ স্বপ্নই ঘুমভাঙার পর মনে থাকছে না। কোন কোনটা অবছা আবছা মনে থাকছে। স্বপ্নে দেখছি, সেই-ই ছোট্ট বেলায় আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো। কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরার জন্য কী প্রাণপণ দৌঁড়ানো। আর মাটিতে গুতো খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়া। তারপর দেখছি মাছধরা, ফুটবল খেলা। বন্ধুদের নিয়ে ধানের ক্ষেতে লাফিয়ে বেড়ানো। স্বপ্নে একা একা আকাশে উড়ে বেড়ানো। বেশি উপরে উঠে গেলে কী ভয়! আবার কখনও কখনও দেখছি, পুলিশ তাড়া করছে। আমি দৌঁড়াতে পারছি না। পা দুটো থাই পাহাড়ের মতো ভারী। যতো জোর করেই উঠাতে চাচ্ছি, কিছুতেই পারছি না। হাঁপিয়ে উঠছি। বাধ্য হয়ে পাখির মতো উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। প্রাণ-পণে হাত ওঠা-নামা করাচ্ছি। উড়ছি। কিন্তু যতো উপরে ওঠা প্রয়োজন এবং যতো জোরে যাওয়া প্রয়োজন, যেতে পারছি না। শরীরটা ভারী হয়ে গেছে। এদিকে পুলিশ একেবারে কাছে এসে পড়েছে। শুধু মাটিতে পড়ে যাচ্ছি। সর্বশক্তি দিয়ে সাঁতরানোর মতো হাত নাড়ছি। সামনে একটি উঁচু দেয়াল। উপরের দিকে উঠতে না পারলে আটকে যাবো, টপকাতে পারবো না। পুলিশ এসে ধরে ফেলবে। জোরে চেষ্টা করেও ওই দেয়াল ডিঙাতে পারলাম না। পুলিশ ধরে ফেলছে। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল।
আরেক কাঁৎ হয়ে শুলাম। আবার চলে যেতে হলো স্বপ্নের রাজ্যে। কখনও কখনও সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখছি। অস্পষ্ট, ঝাঁপসা। মা আদর করছে। একসঙ্গে গল্প করছি। ঝাঁপসা হওয়ায় খুব কষ্ট পাচ্ছি। কতো কতো যে ঝাঁপসা স্বপ্ন ......।
-------- চলবে --------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message