রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন .
একরিপোর্টার হতে তখন প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রির দরকার হতো না। শুধু রিপোর্টার কেন! সম্পাদক হতেও ডিগ্রি লাগতো না। তবে একটা যোগ্যতা লাগতো। সেটা হলো- বামপন্থী হওয়া। বিশেষ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদে ভাল পড়াশুনা থাকতে হতো। এ যোগ্যতাই প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে হার মানাতো। আর বামপন্থী ক্যাডার হলে তো কথাই ছিল না।
আমার যখন রিপোর্টারের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি, তখন ১৯৭৯ সাল। দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন। সবে জেল থেকে বেরিয়েই এ পথে। তার ঠিক আগে বয়স কতোই-বা! বড়জোড় ১৫। পৈত্রিক বাড়ি ছিল পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায়।
এই হাতেখড়ির একটা ইতিহাস ছিল। স্কুলে যাচ্ছেতাই খারাপ ছাত্র হলেও গল্পের বই পড়ায় দারুণ ঝোঁক ছিল। পারলে রাতদিন ডুবে থাকতাম। এভাবে শিশু বয়সেই অসংখ্য বইপড়া হয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব এবং স্কুল লাইব্রেরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরির বই পড়ে পড়ে অন্যরকম এডভেঞ্চারি এবং অনুসন্ধানী চরিত্র তৈরি হয়েছিল। মনোজগতে এরসঙ্গে যোগ হয়েছিল বিজ্ঞান আর ইতিহাসভিত্তিক বইপত্রের শিক্ষা। সবশেষে যোগ হয়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দীক্ষা এবং বাম রাজনীতির ক্যাডার হিসেবে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার অভিজ্ঞতা। বলা যায় বালক বয়সেই ষোলকলা পূর্ণ।
লেখালেখির অভ্যাসটা তখন থেকেই। শুরুটা ছিল ডায়েরি দিয়ে। তারপর চিঠিপত্র। কবিতা লেখা। ছবি আঁকা। এমনকি গল্পের বই লেখার চেষ্টাও বাদ যায়নি। রাজনৈতিক জগতে প্রবেশের পর এসব লেখালেখি খুব কাজে লেগেছিল। কার্যক্রমের নোট লেখা, এজেন্ডা লেখা, প্রচারপত্র লেখা, সভার বিবরণী তৈরি করা ছিল প্রধান কাজ। এক সময় প্রেসরিলিজ লেখার দায়িত্বটাও আমার উপর এসে যায়। সেই থেকে ‘সংবাদ’ লেখার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়।
আমার দারুণ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় (সাপ্তাহিক বিচিত্রা) ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ শিরোনামে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের ধারাবাহিক লেখা আমাকে এতোটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে, এই পেশাটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় চাওয়া-পাওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাংবাদিকতা যে কতোবড় সম্মানের পেশা- আমার কাছে তার একটা উদাহরণ ছিল শহরের রূপকথা রোডের ঘটনা।
ওই রোডে প্রায়ই ৪/৫ জনের একদল সাংবাদিক রাতের বেলা পায়চারি করার মতো হেঁটে হেঁটে গল্প করতেন। যদিও জনসংখ্যা তখন একেবারেই কম ছিল। রাস্তায় কোন ভিড় ছিল না। এরকম সময় সাংবাদিক দল যখন রাস্তায় নামতেন তখন দুপাশের দোকানপাট-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে একটা রাখঢাক পড়ে যেত। বসে থাকা লোকজন চুপচাপ হয়ে যেতেন। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলতেন না। কোন আলতু-ফালতু আচরণ করতেন না। সামরিক শাসনের সময়ের মতো সবকিছু ফিটফাট, নির্ঝঞ্ঝাট হয়ে যেত। আর লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন সাংবাদিকদের দিকে। যেন তাঁরা সপ্তম আশ্চর্যের মানুষগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। আমিও ওভাবেই দেখতাম। কেউ কেউ ইঙ্গিত করে বলতেন, ‘ওই যে, ওঁনারা কিন্তু সাংবাদিক, সবাই সাবধান।’ এটা কিন্তু ভয় পাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। সম্মানীদের সম্মান করতেই, বা তাঁদের উপস্থিতিতে কোন বেয়াদবি হয়ে না যায়- সেটা ঠিক রাখতেই এ সাবধানতা। যে ৪/৫ জন সাংবাদিক এভাবে হাঁটাচলা করতেন তাঁরা ছিলেন এডভোকেট রণেশ মৈত্র, আনোয়ারুল হক, মির্জা শামসুল ইসলাম, হাসনাতুজ্জামান হীরা, আবদুস সাত্তার বাসু, শিবজিত নাগ, রবিউল ইসলাম রবি ও আবদুল মতিন খান।
----- চলবে ----
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message