উন্মোচন
আবুল হোসেন খোকন
[প্রারম্ভিক কথা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরই ধারাবাহিকতায় আশির দশকের শুরুতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন আরেক সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। অবৈধ এবং অসাংবিধানিক এইসব ঘটনার মৌলিক প্রেক্ষাপটকে অবলম্বন করেই ১৯৮৩ সালে ‘উন্মোচন’ পথনাটকটি রচনা করা হয়। এরশাদের সামরিক শাসন চলাকালে দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়ে এই পথনাটকটি গেরিলা কায়দার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পাবনার শহরাঞ্চলে অর্ধশতাধিক জায়গায় প্রদর্শন করা হয়েছিল। পরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কয়েকটি প্রকাশ্য মঞ্চেও এটি প্রদর্শন করা হয়।
‘উন্মোচন’ মূলত সামিরক শাসনবিরোধী পথনাটক। নাটকটির সংলাপ ও আদল হুবহু অক্ষুণ্ন রেখেই এখানে তুলে ধরা হলো।] নাট্য চরিত্র ১. উন্মাদ : প্রতীকি পাগল ২. ড্রাইভার : প্রতীকি মটরযানের চালক ৩. মালিক : প্রতীকি মটরযানের মালিক ৪. সামরিক অফিসার : সামরিক অফিসার ৫. রাজনৈতিক নেতা : রাজনৈতিক নেতা ৬. ধর্মীয় গুরু : ধর্মীয় গুরু প্রথম দৃশ্য :-
[ দৃশ্য চরিত্র :
উন্মাদ ও ড্রাইভার ] [মূল পর্দা খোলার পর পিছনের পর্দায় বাংলাদেশের মানচিত্রের মধ্যে যাত্রী বোঝাই বাঁকা, এবরো থেবরো, রং চটা একটি মটরযানের চিত্র দেখা যাবে। চিত্রে বড় করে ‘নাটক’ শব্দটি লেখা থাকতে পারে। এসময় আনমনাভাবে উন্মাদের প্রবেশ ঘটবে। মঞ্চে প্রবেশ করেই সে সামনের দর্শকদের দেখতে পেয়ে অবাক হবে এবং তারপর ঘুরে পর্দায় টাঙানো চিত্র দেখবে। তারপর আস্তে আস্তে দর্শকদের দিকে ঘুরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে] উন্মাদ : হা হা হা হা হাহ্ হাহ্ হা। হাহ্ হা হা হা হাহ্ হা। হা হা হা হাহ্। [আঙুল তুলে দর্শকদের দেখিয়ে] নরকের কীট সব, বোকার হদ্দরা সব। [ব্যঙ্গ করে] নাটক দেখতে এসেছে! ধানমন্ডি বনানী গুলশানে নতুন নতুন বাড়ি, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি! গড়ে উঠছে ব্যাংক-ব্যালেঞ্চের পাহাড়! রাঘব বোয়ালগুলোর গায়ের চর্বি বাড়তে বাড়তে গড়িয়ে পড়ছে! [দর্শকদের উদ্দেশ্য করে] আর তোমরা? তোমার-আমার হচ্ছে কি? বলো কি হচ্ছে? আমার চোখের সামনে দালান-কোঠা-বিল্ডিং, একে একে গড়ে উঠছে [মঞ্চের অন্য একদিকে আঙুলি নির্দেশ করে] ওদের! [দর্শকদের উদ্দেশ্য করে] আর তোমাদের? তোমাদের-আমাদের জমি-জমা ফুরাতে ফুরাতে ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে কোথায় ওগুলো? আমাদের শুধু যাচ্ছে, [মঞ্চের অন্য একদিকে আঙুলি নির্দেশ করে] ওদের শুধু বাড়ছে। আমরা মরছি বিনা-চিকিৎসায়, অর্ধাহারে-অনাহারে। কাপড়ের অভাবে লজ্জা ঢাকতে পারি না! কেন? কেন?? দেশে প্রতিবাদ তো কম হচ্ছে না, মিছিল তো কম হচ্ছে না, রক্ত তো কম ঝরছে না! তবে, কেন এ অবস্থা দূর হচ্ছে না? কেন এমন ধারা পাল্টাচ্ছে না? আই ওয়ান্ট নো হোয়াই? আমি বলবো, বলবোÑ [দর্শকদের প্রতি আঙুলি নির্দেশ করে] তোমাদের জন্য। তোমরা চোখ বন্ধ করে থাকার জন্য। এ জন্য দায়ী তোমরা। তোমরাই এগুলো ঘাড়ে করে রেখেছো। তোমরা অন্ধ, তোমরা বোবা, তোমরা কালা, হাহ্ হা হা হা ----------
আমাকে উন্মাদ মনে করছো? না, নাহ্, আমি উন্মাদ নই। আমি এমন ছিলাম না। আমি যেদিন থেকে চোখে সব দেখতে পাচ্ছি, সেদিন থেকেই কিছু সইতে পারি না। আমি, আমি তোমাদের জন্য এমন হয়েছি। তোমাদের চোখ-কান-বিবেক বন্ধ থাকার জন্য উন্মাদ হয়েছি। জানো, আমি একদিন এমন ছিলাম না। সেদিন, তোমাদের মতো সব দেখেও চোখ বুঁজে থাকতাম, সব শুনেও কালা হয়ে থাকতাম, কিছু বলতে যেয়েও [মঞ্চের অন্য একদিকে আঙুলি নির্দেশ করে] ওদের ফতোয়ায় মুখ বুঁজে থাকতাম। তোমাদের মতো বাঁচার পথ দেখতাম না। কিন্তু, যেদিন নাটক দেখলাম, সেদিন আমার সব ভুল ভাঙলো, সব দৃষ্টি খুলে গেল। আমি কেমন হয়ে গেলাম! [কঠোর দৃষ্টিতে দর্শকদের প্রতি] কিন্তু, তোমরাই শুধু নাটক দেখতে পারলে না। আজ এসেছো নাটক দেখতে? নাটক দেখেই তো আমি তোমাদের ঘৃণা করি। সেই নাটক দেখতে এসেছো তোমরা? কিন্তু, কিন্তু দেখে কী লাভ? বলো কী লাভ? [আপন মনে] হ্যাঁ, তবে দেখো। দেখে [দর্শকদের প্রতি] চোখ বুঁজে থেকো না। [মঞ্চের প্রতিকৃতির দিকে নির্দেশ করে] দেখো, ওই দেখো- একটা মটরযান। বাঁকা, ভাঙা, এবড়ো- থেবড়ো, সিট ভাঙা, নাটবল্টু ভাঙা, তার ছোঁড়া, চাকা লিক- মটরযান। এর ‘আসল’ জিনিস ‘ইঞ্জিন’টা, বহুদিন বহুযুগ থেকে নষ্ট হয়ে আছে। এই ইঞ্জিন কেও সাড়ে না। তাই এ যান- নষ্ট, অকর্মন্য, অথর্ব। জানো, এই যানের আবার মালিক আছে, ড্রাইভার আছে, হেলপার আছে, আছে যাত্রীও। হ্যাঁ, মালিক-ড্রাইভার-হেলপার মিলিয়ে আছে পাঁচ জন, আর যাত্রী আছে পঁচানব্বই জন। বলতে পারো- এর গন্তব্যস্থল কোথায়? হাসি পাচ্ছে? হাসি পাচ্ছে না? হে: হে: হা: হা: ---------। হ্যাঁ, ঠিকই তো, হাসি তো পাবেই। একটি অচল গাড়ি, তার আবার গন্তব্য! কিন্তু তবু জানার আছে। এই দ্যাখো. দ্যাখো, এসো, ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি। [মঞ্চের অন্য পাশে লক্ষ্য করে] এ এ এই যে ড্রাইভার সাহেব, শুনুন, শুনুন- [ড্রাইভারের প্রবেশ]। আচ্ছা, আপনি তো ড্রাইভার। তা আপনার মটরযানের গন্তব্যস্থল কোথায়? ড্রাইভার : [মঞ্চের একদিকে দেখিয়ে] ওই সামনের স্টেশনে।
উন্মাদ : সামনের স্টেশন? কি আছে ওখানে? ড্রাইভার : কি আবার আছে, কিছুই নেই। উন্মাদ : আছে, আছে। প্লিজ, বলুন না স্যার। [ড্রাইভারের পা জড়িয়ে ধরবে] ড্রাইভার : আহ্ হা, ঝামেলা করছো কেন? আমার এখন সময় নেই। [ড্রাইভার চলে যেতে উদ্যত হবে। উন্মাদ ছুটে ছুটে গিয়ে কাকুতি মিনতি করবে।] উন্মাদ : দোহাই লাগে স্যার, আমাকে বলে যান না স্যার। ড্রাইভার : আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লামরে বাবা! তোমার ওসব দিয়ে কী লাভ? উন্মাদ : এমনি স্যার, এমনি শুনবো স্যার। ড্রাইভার : হুঁ, ঠিক আছে বলছি। তবে সাবধান, এসব কথা কাওকে বলো না কিন্তু। বিশেষ করে [দর্শকদের দেখিয়ে] ওই যাত্রীদের। উন্মাদ : আচ্ছা স্যার, আচ্ছা। বলবো না, কাওকে বলবো না স্যার। ড্রাইভার : ওখানে আছে শান্তি আর সুখ। তোমাদের সবার সুখ জমানো আছে ওখানে। ওখানে আছে ঐশ্বর্য, এক কথায়- বেহেস্ত। ওখানে আমার মালিক থাকেন, আমিও থাকি, হেলপারও মাঝে মাঝে থাকে। উন্মাদ : ও বুঝেছি, ওই স্টেশনে আপনার মটরযান যাবে? হে: হে: হে: ------। কিন্তু, কিন্তু কী করে? আপনার মটরযান তো অচল! ড্রাইভার : আহ্ হা, তুমি আসলেই আস্ত পাগল! যানকে চালু রাখার কথা ভাবছো কেন? চালু রাখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে না! উন্মাদ : মানে স্যার, কিছুই বুঝলাম না। ড্রাইভার : মানে? হে: হে: হা: হা: --------। মানে, তাহলে যানটা স্টেশনে পৌঁছে যাবে না? আর তাহলেই তো সর্বনাশ। ওই সুখ, শান্তি আর বেহেস্তে যাত্রীরা পৌঁছে যাবে না! তখন? তখন আমার মালিক, আমি কোথায় থাকবো? সুখ কোথায় পাবো? বেহেস্তটা ওরা দখল করে নেবে না! উন্মাদ : কেন? তাতে দোষ কি স্যার? সবাই বেহেস্তে থাকবেন। ড্রাইভার : তুমি সত্যিই পাগল! কোথায় পাঁচ জন, আর কোথায় পঁচানব্বই জন! যুগ যুগ ধরে হাতে রাখা আরাম, আয়েশ, অধিকার- পাগলের মতো তুমি [দর্শকদের দেখিয়ে] ওদের হাতে ছেড়ে দিতে বলো? উন্মাদ : আচ্ছা স্যার? ওখানে বেহেস্ত গড়ে উঠলো কেমন করে? ড্রাইভার : হেহ্ হেহ্ হেহ্ হে: হে: -------। তাও জানো না? আর তুমি জানবেই বা কেমন করে? আসলে আমার মালিক আর আমরা- বোকা নই। বরং [দর্শকদের দেখিয়ে] যাত্রীদের বোকা বানিয়েই, যাত্রীদের সম্পদ দিয়েই ওই বেহেস্ত তৈরি। আমরা [দর্শকদের দেখিয়ে] ওদের খাটুনি থেকে খাটুনির দাম মেরে দেই, মটরযার রক্ষণাবেক্ষণের নামে ট্যাক্স নিই, [দর্শকদের ইঙ্গিত করে] ওদের উন্নয়নের কথা বলে- বিদেশি সাহায্য আর ঋণ নিই। এভাবেই ওদের অজান্তে, ওদের সম্পদ দিয়েই- ওই বিশাল বেহেস্ত গড়ে উঠেছে। [দর্শকদের ব্যঙ্গ করে] বোকার হদ্দরা কোন দিনও বুঝতে পারবে না যে- এই যানে চড়ে কোনদিনও তারা এগুতে পারবে না। হা: হা: হা: হা: -------।
উন্মাদ : ও,
বুঝেছি। আসলে আপনারাÑ যাত্রীদের কোনদিনও স্টেশনে পৌঁছাতে দিতে চান না। ড্রাইভার : ঠি-ক ধরেছো। আমার মালিকের ইচ্ছায়Ñ মটরযান কোনদিন এগুতে পারবে না। হা: হা: হা: হা: ----। উন্মাদ : কিন্তু, কিন্তু ব্যাপারটা যদি কোন সময় [দর্শকদের দিকে ইঙ্গিত করে] যাত্রীরা বুঝে ফেলে? জেনে যায় স-ব! তখন? তখন কি হবে আপনাদের? ড্রাইভার : [কঠোরভাবে] অসম্ভব। সহজে তা জানতে পারবে না। আর পারলেও ক্ষতি নেই। কিচ্ছু করতে পারবে না। সব ব্যবস্থা ঠিক আছে। দেখবে তা? দেখবে? উন্মাদ : হ্যাঁ, দেখবো। ড্রাইভার : তাহলে এসো আমার সাথে। [উভয়ের প্রস্থান] ---------- চলবে ---------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message