রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
ছয়. এর বেশ আগে একটা কান্ড ঘটে যায়। সন্ধ্যারাতে প্রেসক্লাবে যেতেই শিবজিত দা হঠাৎ ডেকে নিয়ে গেলেন ছাদের দিকে। বললেন, তিনি পাবনা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক বিবৃতি’তে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রকাশক ইয়াসিন আলী মৃধা রতন তাঁকে বার বার অনুরোধ করছেন। সে কারণে তিনি তার অনুরোধে সাড়া দিতে চান।
তাঁর নিজের সঙ্গে নিতে চান আমাকেও।
অর্থাৎ শিবজিত দা
আর আমি নতুন হিসেবে সাপ্তাহিক বিবৃতিতে যোগ দেবো। বিবৃতি পত্রিকা পাবনার অত্যান্ত প্রভাবশালী সংবাদপত্র। পাবনা থেকে এসময় দুটি সংবাদপত্রই বের হচ্ছিল। একটি বিবৃতি, আরেকটি সাবেক বামপন্থী নেতা শফিউর রহমান খানের সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক পাবনা বার্তা’। এর প্রকাশকও শফিউর রহমান খান। বিবৃতির সম্পাদক ছিলেন শফিকুল ইসলাম শিবলী, সংক্ষেপ লেখা হতো শ. ই. শিবলী। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক এবং আইনজীবী।
পরে জেনেছিলাম, কোন কারণে তাঁর সঙ্গে প্রকাশক রতন ভাইয়ের সম্পর্কের অবণতি ঘটে। শিবলী ভাই পদত্যাগ করেন। তখন রতন ভাই নতুন সম্পাদক খুঁজছিলেন। তিনি শিবজিত দাকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছেন। এই ঘটনা থেকেই দাদাকে ওই দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব বা অনুরোধ জানানো হয়। দাদা আমাকে সঙ্গে রাখার শর্তে এতে রাজী হন।
দাদার প্রস্তাব আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম।
তারপর একদিন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে দাদা এবং আমি বিবৃতিতে যুক্ত হই। শিবজিত দা
শিক্ষকতায় সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম প্রিন্টার্স লাইনে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় তিনি সম্পাদক থাকলেও প্রিন্টার্স লাইনে ‘অবৈতনিক সম্পাদক’ পদবী ব্যবহার করেন। এতেকরে সরকারি চাকরি করে অন্য কোথায়ও
‘লাভজনক চাকরি’ করার বিধান থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা সুযোগ ছিল।
অবশ্য প্রতিপক্ষের কেউ কেউ এরপরেও হেনস্তা করতে ছাড়েনি। যাইহোক, আমার দায়িত্ব প্রথমে হয়
নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে। পরে এক ঘটনায় প্রকাশক আমার পদবী লিখেছিলেন বার্তা সম্পাদক হিসেবে। শেষে এই
পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও আমাকে নিতে হয়েছিল। সে যাইহোক, শুরু থেকেই এই পত্রিকার মূল ছিলেন প্রকাশক রতন ভাই এবং শিবলী ভাই ছাড়াও জাহাঙ্গীর আলম মুকুল, শ্যামল দত্ত, আবু মুহাম্মদ রইস, শুচি সৈয়দ, সমজিৎ পাল, মোস্তফা আরব সতেজ, সেলিনা খান শেলী, শামসুল আলম বকুল, মুকুল আহমেদ, জয়নাল আবেদীন, অমল কান্তি সরকারসহ অনেকে। এঁরা সবাই ছিলেন পাবনায় কবিতা চর্চার সুপরিচিত সংগঠন ‘কবিকণ্ঠ’র কর্ণধার। এক কথায় কবিকণ্ঠ থেকেই জন্ম নেয় ‘বিবৃতি’। দাদাসহ আমি যখন এখানে যুক্ত হলাম তখন পেয়েছি জাহাঙ্গীর আলম মুকুল, শ্যামল দত্ত, শুচি সৈয়দ, সমজিৎ পাল, মুকুল আহমেদ, কামাল আহমেদ, জয়নাল আবেদীন এবং অমল কান্তি সরকারকে। এরমধ্যে জাহাঙ্গীর আলম মুকুল এবং শ্যামল দত্ত ঢাকা চলে গেলেন, সেখানেই তাঁরা দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন। রইলাম মাত্র শিবজিত দা এবং আমিসহ, শুচি সৈয়দ, সমজিৎ পাল, মুকুল আহমেদ, জয়নাল আবেদীন এবং অমল কান্তি সরকার।
এখানে আরেকটা কথা বলতে হয়। সেটা হলো বিবৃতি যেমন জন্ম নিয়েছিল কবিকণ্ঠের ঘর থেকে, তেমনইভাবে বিবৃতির ঘর
থেকে জন্ম নিয়েছিল পাবনার অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গণশিল্পী সংস্থা।
বিবৃতি ছাপা এবং প্রকাশ হতো বেনিয়া পট্টির বাণী মূদ্রণ থেকে। এই প্রেসের মালিকও ইয়াসিন আলী মৃধা রতন।
এই বাণী মূদ্রণ গড়েছিলেন রতন ভাইয়ের বাবা ইউসুফ আলী মৃধা। তিনি পাবনার বিখ্যাত বাস মালিকই শুধু ছিলেন না,
প্রকাশনা এবং শিল্পকর্ম চিন্তার দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত গুণী মানুষ। সে কারণে তাঁর ছেলে ইয়াসিন আলী মৃধা রতনও কবিতা সংগঠন, প্রকাশনা এবং শেষ পর্যন্ত বিবৃতির মতো একটি সংবাদপত্র প্রকাশের দিকে ঝুঁকেছিলেন।
শিবজিত দা দায়িত্ব নেওয়ার পর
পত্রিকার নতুন অফিস করা হয় ব্যাংক রোডের দোতলায়।
আগে বাণী মূদ্রণকেই অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। নতুন অফিসটি দারুণভাবে জমে উঠেছিল। তিনটা রুম ছিল।
একটা রুমে শিবজিত দা বসতেন। আর একটিতে প্রতিবেদকরা বসতেন। মাঝের রূমটা ছিল কম্পোজ এবং বিজ্ঞাপন সেকশন। আমাদের কাজের দিনগুলো ছিল অসাধারণ। এখানে বলে রাখা দরকার- আমরা কিন্তু কেউ বেতনভূক ছিলাম না। স্বতঃপ্রণোদিত কর্মী ছিলাম আমরা। সম্পাদক শিবজিত দাও বেতন পেতেন না, বা নিতেন না। আমরা নিজের শ্রম দিয়ে কাজ করতাম বিনা পয়সায়। টুকিটাকি খরচও নিজেদের থেকেই করা হতো।
প্রকাশক রতন ভাই শুধু অফিস সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁকে কাগজ-কালি ও
ছাপার খরচ ঠিকই বহন করতে হতো।
নিজেদের প্রেসে যেহেতু ছাপা, সে কারণে এই খরচটা দৃশ্যত লাগতো না। পত্রিকা বিক্রি করে, আর বিজ্ঞাপন থেকে যা
আয় হতো- তা পত্রিকার আনুসঙ্গীক খরচেই লেগে যেতো। উপরন্তু ভর্তূকি দিতে হতো রতন ভাইকে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে- আমরাই-বা কেন বিনে পয়সায় কাজ করতাম, আর রতন ভাইই-বা কেন গাঁটের পয়সা খরচ করতে যেতেন? এর একটাই জবাব, আমরা একটা দর্শন নিয়ে চলতাম। মানবসেবা এবং এরজন্য সাংবাদিকতা ছিল আমাদের দর্শন। আর সে কারণেই আমরা এভাবে কাজ করতাম।
আগে বলেছি, আমাদের দিনগুলো ছিল অসাধারণ।
শিবজিত দা সরকারি চাকরির আগে-পড়ে এসে বসতেন বিবৃতিতে। তিনি তখন তুখোর সাংবাদিক। আর সম্পাদক হয়ে দেখিয়েছেন আরও মুন্সিয়ানা। যা কিনা দেশের বড়
বড় পত্রিকা, পত্রিকার সম্পাদক এবং গুণী ব্যক্তিত্বরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন।
আর শুচি সৈয়দ, সমজিৎ পাল, মুকুল আহমেদ, জয়নাল আবেদীন, অমল কান্তি সরকার এবং আমার কাজ ছিল সকাল-বিকাল-রাতে জমিয়ে কাজ করা। এটা করতে গিয়ে দারুণ আড্ডা জমতো। শিবজিত দা
থাকতেন এর মধ্যমনি। প্রকাশক রতন ভাই ছিলেন সব
কিছুতে উজার করা উৎসাহদাতা। ঢাকা থেকে নানান বুদ্ধি-পরামর্শ, লেখা এবং বিজ্ঞাপন নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম মুকুল ও শ্যামল দত্ত হাজির হতেন প্রায়ই।
এই আড্ডাগুলোর কোন তুলনাই হয় না। এ আড্ডা কোন ধুম-ধারাক্কা আড্ডা বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। ছিল শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন নির্ভর ঘটনা নিয়ে শিক্ষামূলক আড্ডা। এর মধ্যদিয়েই চলতো লেখালেখি।
তৈরি হতো পরিকল্পনা, দিকনির্দেনা এবং মাঠের কাজের ক্ষেত্র। এইসবের মধ্যদিয়ে আমরা সাংবাদিকতায় হয়ে উঠছিলাম দক্ষ থেকে আরও দক্ষ। আড্ডার বাইরেও ছিল মজার মজার নানা কান্ডকারখানা। বিবৃতি ছিল আমাদের বাড়িঘর। তাই কোনদিন দেখা যেতো, রাতে কাজ করতে করতে বাড়িতেই ফিরলো না কেউ। কোন রকমে দোকান থেকে কিছু খেয়ে কাঠের চেয়ারগুলো জড়ো করে তার উপর ঘুমিয়ে পড়া হতো। প্রচন্ড গরমের দিনে তো সমস্যার কমতি ছিল না। কারণ সব ঘরে ফ্যান ছিল না। আর ফ্যান থাকলেই-বা
কি! মশা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন- এগুলো কতো শক্তিশালী দল। দেখা যেতো জামা-কাপড় সব খুলে চেয়ারের উপর টানটান হয়ে এক-দুইজন ঘুমিয়ে পড়েছে।
আর তাদেরকে ঢেকে রেখেছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মশা।
মশা দিব্বি রক্ত খেয়ে শরীরেই পড়ে থাকতো। বেচারা যারা বেহুঁশের মতো ঘুমাতেন- তারা এগুলো খেয়ালই করতেন না। সকাল বেলা যখন শুকনো শরীর ফুলে মোটা কিংবা রক্তাক্ত দেখা যেতো- তখনই বোঝা যেতো আসল অবস্থা। এ নিয়ে নানা রকম হাসি ঠাট্টাও জমতো একে-অপরকে নিয়ে।
আবার বৃষ্টির দিনে দেখা যেতো কেউ ভিজে জবজবে হয়ে কাজে বসে পড়লেন।
শীতের দিতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এসে হিটার জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে লাগলেন।
কিংবা রাতে ছাপা নিউজপ্রিন্ট গায়ে দিয়ে সেগুলোকেই লেপ-কাঁথা বানাতেন। এরকম নানা ঘটনা।
এতে কারও কোন আক্ষেপ ছিল না। ছিল কেবলই উৎসাহ আর উদ্দীপনা। আর এই সময় যদি রতন ভাই নিচের ভাজা সিঙারা বা
চপ কিনে নিয়ে হাজির হতেন- তখন আনন্দের শেষ ছিল না। ঝাল-মুড়ির আড্ডা ছিল আরও মজার। এই বিবৃতিতে আমরা খবর লিখতাম, সে খবর দেখে দিতেন শিবজিত দা। তারপর সেই খবর হ্যান্ড কম্পোজ হতো।
কখনও কখনও বিশেষ কারণে কম্পোজিটর না এলে তখন নিজেরাই বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে স্টিকে বসিয়ে কম্পোজ করতে হতো। এখানেই শেষ নয়। সেই কম্পোজ করা ম্যাটার টাইট করে বেঁধে নিচে নামিয়ে কালি ডলতে হতো রুলার দিয়ে।
তারপর তার উপর নিউজপ্রিন্ট সেঁটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাপতে হতো।
তাতেকরে যে ছাপ বসতো, সেগুলোর প্রুফ হিসেবে নিজেদেরই দেখে ঠিক করতে হতো। সবকিছু চূড়ান্ত হলে সেই ম্যাটার প্রেসে যেতো। প্রেসেও আমাদের দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করতে হতো।
কাগজের বান্ডিল গোছাতে হতো। তখনকার দিনের কাজই ছিল এইরকম।
একের ভিতর বহুগুণ বলা যায় একে।
এরপর সবকিছু ঠিক থাকলে ভোর বেলা জয়নাল ভাই বাইসাইকেল নিয়ে বের হতেন পত্রিকা বিলি করতে।
তিনি একাধারে বিজ্ঞাপন ম্যানেজার, সার্কুলেশন ম্যানেজার, হকার এবং বিল কালেক্টর। আমাদের সবার কাজই ছিল এই
রকমের। কে যে কী দায়িত্বের- এসব ছিল না। সব কাজই ছিল সবার।
আমরা আবার নতুন গ্রাহক তৈরির জন্য দল বেঁধে মাঠেও নামতাম। এতেকরে মানুষ সাড়া দিতেন দারুণভাবে। লাফিয়ে লাফিয়ে পত্রিকার সার্কুলেশন বেড়ে যেতো।
আমাদের এইসব কাজ দেখে এগিয়ে এসেছিলেন অনেক প্রথিতযমা মানুষ। যেমন এসেছিলেন সাংবাদিক আনোয়ারুল হক, এডভোকেট রণেশ মৈত্র, অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন জাহেদী, ডা. রাম দুলাল ভৌমিক, অধ্যাপক আবদুল মান্নান তালুকদার, মীর্জা শামসুল ইসলাম, আবদুল মতীন খান, রবিউল ইসলাম রবি, সুশীল তরফদারসহ অনেকে। পরে কর্মী হিসেবে আরও অনেকেই আড্ডার মহোৎসবে যোগ দিতেন এবং তাঁরাও বিবৃতির পরিবার হয়ে ওঠেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message