স্মৃতিকথা- সাত
রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
আশির দশকের সময়গুলো এখনকার মত ছিল না। রিপোর্টিংয়ের জন্য আমাদের পায়ে হেঁটে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার গিয়ে বিটে পৌছাতে হতো। পায়ে হাঁটার কারণটা অর্থনৈতিক। আমাদের এমন টাকা-পয়সা ছিল না , যা দিয়ে রিকশায় যাবো। যদিও রিকশা ভাড়া এখনকার মত ছিল না। অফিস থেকে ডিসি অফিসের দূরত্ব আড়াই-তিন কিলোমিটার মত। রিকশা ভাড়া চার আনা থেকে আট আনা ছিল। মানে এক টাকার চার ভাগের একভাগ বা আধা ভাগ। সেটাও আমাদের জন্য খরচ করা বেশ কঠিন ছিল। বোঝার জন্য বলছি, আমি যখন বিবৃতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন বেতন বা সম্মানী ছিল না। কিন্তু পরে রতন ভাই একটা টোকেন সম্মানী দেওয়া শুরু করলেন। যার পরিমাণ ছিল মাসে দেড়শ টাকা। মানে পত্রিকার সম্পাদকের সম্মানী দেড়শ টাকা মাসিক। এই দেড়শ টাকাকে দেখতে হবে এখনকার হিসাবে আরও দুই শূন্য যোগ করে। অর্থাৎ তার পরিমাণ ১৫ হাজার টাকা। সুতরাং রিকশা ভাড়া চারআনা-আটআনাকে কম পয়সা বলা যাবে না। আমরা রিকশায় চড়তাম না। আমাদের সম্পাদক শিবজিত দাও রিকশায় চড়ে সাংবাদিকতা করেছেন- এমনটি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং তিনিও দল বেধে হেঁটে হেঁটে আমাদের সঙ্গে যেতেন। নিয়মিত রিকশায় চড়তেন কেবলমাত্র আমাদের প্রকাশক ইয়াসিন আলী মৃধা রতন। কারণ ওই সময় পাবনার সবচেয়ে প্রভাবশালী বা মান্যগণ্য ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন তিনি। মটর মালিক হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল উপরের সারীতে। এক নামেই তাঁকে চিনতের পাবনার সব মানুষ। তাই তাঁর পায়ে হেঁটে চলাটা মানানসই ছিল না। যাই হোক, আমরা হেঁটে খবর পাওয়ার যায়গাগুলোতে যেতাম, সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বা সাক্ষাৎকার নোটবুকে টুকে নিয়ে আসতাম। তারপর অফিসে বসে লিখতাম। তবে হ্যাঁ, আমাদের গাড়ি বা মটরসাইকেল না থাকলেও কাজের জন্য দ্রæতযান একটা ছিল। সেটা হলো জয়নালের বাইসাইকেল। বিবৃতির ওই একটাই বাইসাইকেল। সেটা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, পত্রিকা বিলি, বিল কালেকশনের কাজ ছাড়াও খবর সংগ্রহের জন্য আমরা ব্যবহার করতাম। রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য আমরা কখনও একা, আবার কখনও দল বেঁধে যেতাম। শিবজিত দা, রতন ভাইও প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যেতেন। আর রিপোর্ট বলতে আমরা জনস্বার্থ সংক্রান্ত নানান তথ্য সংগ্রহ করতাম। নানা ঘটনার খবর সংগ্রহ করতাম। গোপন থাকা অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা জনগণের সামনে প্রকাশ করে দিতাম। এ ক্ষেত্রে কোনরকম ব্লাকমেইল বা স্বার্থ হাসিলের চিন্তা আমাদের ছিল না। এমন কাজকে আমরা সাংবাদিকতার নীতি এবং আমাদের নৈতিক আদর্শের পুরো পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করতাম। যদিও শেষ পর্যন্ত এরকম নৈতিকতা পাবনায় শতভাগ টিকে থাকেনি। আশির দশকের মাঝামাঝির দিক থেকে সামরিক শাসক এরশাদ তার হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাংবাদিকদের নষ্ট করে দিতে থাকেন। নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেন। লোভ-লালসায় ফেলে কারও কারও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে এর শিকার খুব কমজনই হয়েছেন। কারণ তখন নৈতিকতার শক্তিরই প্রাধান্য ছিল। আমাদের এই সময়টাতে সাংবাদিকদের যে কী মর্যাদা ছিল- তা এখন কল্পনাও করা যায় না। মানুষ দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী বা ডিসি-এসপিকে যতোটা না গুরুত্ব দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সাংবাদিকদের মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছেন। এ সময় আমরা অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টিংয়ের জন্য নানান পন্থা অবলম্বন করেছি। একবার শুচি সৈয়দ আর আমি অফিস থেকে ছুটলাম সিঙ্গা গ্রামের অনেক ভেতরের দিকে। আমরা অফিসে বসে একটা হিসাব-নিকাশ করেছিলাম। তখন পাবনার উপর দিয়ে আন্তঃনগর ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোথা থেকে যেন খবর পেয়েছিলাম যে, বিদেশিদের অর্থে নির্মিত এই লাইন স্থাপনে বড় রকমের দুর্নীতি করা হয়েছে। শহরের দিকে লাইনের উচ্চতা যে পরিমাণ করা হয়েছিল, গ্রামের দিকে গিয়ে সেই লাইনে একটা করে ধাপ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতেকরে উচ্চতা কমে গেছে, এবং এক-একটি ধাপ বাবদ লাখ লাখ টাকা লোপাট হয়েছে। এই তথ্যটা সরেজমিনে কীভাবে যাচাই করা যায়- তারই একটা হিসাব তৈরি করেছিলাম। আমাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, লাইনে ধাপ কম বসানো হয়েছে- তা প্রমাণ করবো কীভাবে? লাইন দেখে তো তা বোঝা যাব না। সুতরাং উচ্চতা মাপতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব? ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইনের উচ্চতা মাপার চিন্তা পাগলামো ছাড়া কিছু নয়। কারণ বেশ কিছুদিন আগে শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া লাইনের নিচে কাজ করছিলেন বিদ্যুৎ অফিসের এক কর্মী। হঠাৎই তিনি ১১ হাজার ভোল্টেজের প্রভাবে নিমেষেই পুড়ে ছাই হয়ে যান। কয়লার গুড়ো ছাড়া তার শরীরের আর কিছু পাওয়া যায়নি। এডওয়ার্ড কলেজ গেটের সামনে এঘটনা ঘটেছিল। সুতরাং অভিজ্ঞ বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরই যখন ১১ হাজার ভোল্টেজে এই দশা হয়েছে, তখন ৩৩ হাজারে আরও কী না হতে পারে! তাই বলে আমরা হাল ছাড়িনি। বইপত্র পড়ে বিদ্যুৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম। তারপর আমরা পরিকল্পনামত শহর থেকে হেঁটে অন্তত ১২/১৪ কিলোমিটার দূরে সিঙ্গা এলাকায় খোলা মাঠের ধান ক্ষেতের মধ্যে চলে যাই। সেখানে কোন জনবসতি ছিল না। আমাদের দুটি পন্থা গ্রহণ করা ছিল। এক হচ্ছে, শুকনো মোটা সুতো নিয়েছিলাম। সেটার মাথায় ইটের দলা বেঁধে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের উপর ছুঁড়ে দিয়েছি। অতো উপরে সহজেই এটা করা যায়নি। অনেকবার চেষ্টার পর বিদ্যুৎ লাইনের উপর দিয়ে সেটা পাঠাতে পেরেছিলাম। তারপর সুতো ঢিল দিয়ে ইটের দলাকে নিচে নামিয়েছিলাম। জ্ঞান অর্জন থেকে জানতাম শুকনো সুতোয় বিদ্যুৎ প্রবাহের ভয় নেই। তারপরেও ৩৩ হাজার ভোল্টেজ বলে কথা। নানাভাবে পরীক্ষা করে যখন নিশ্চিত হয়েছি, তখনই সেই সুতোকে হাত ধরেছি। এভাবে সুতো দিয়ে লাইনের উচ্চতা মেপেছি। আরেকটি পন্থা ছিল, সূর্য্যরে আলোতে মাটিতে পড়া বিদ্যুৎ থাম্বার ছায়া মাপা। আমরা পড়াশুনা করে একটা হিসাব বের করেছিলাম। সেইমত থাম্বার মাপ নিচ্ছিলাম দীর্ঘ সময় ধরে। এক জায়গায় নয়, প্রয়োজনীয় কয়েক জায়গায় গিয়ে একইভাবে মাপগুলো নেওয়া হয়। কাজটি যেমন ছিল দুঃসাহসিক, তেমন ছিল বেশ পাগলামিপূর্ণ। এই বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে এর আগে আরেকটি অভিযান চালানো হয়েছিল। সম্পাদক শিবজিত নাগ, শ্যামল দত্ত, শুচি সৈয়দ, মুকুল আহমেদ, মোস্তাফা আরব সতেজ, অমল সরকার, আমিসহ বেশ কয়েকজন গিয়েছিলাম শহর থেকে দূরে আতাইকুলায়। সেখান থেকে এই বিদ্যুৎ লাইন সম্পর্কে খোঁজ নিতে আরও দূরে একেবারে গ্রামের ভেতর চলে যাই। কারণ তখন সবেমাত্র এই ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হচ্ছে। এ নিয়ে নানা রকম কথাও কানে এসেছে। সেসব যাচাই করতেই আতাইকুলা যাওয়া।
আমরা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করলাম- ওই বিদ্যুৎ লাইনের নিচ দিয়ে যেসব টিনের বাড়িঘর রয়েছে, সেগুলো আপনা-আপনি বিদ্যুতায়িত হয়ে থাকছে। এই বিদ্যুৎ দিয়ে তারা লাইট জ্বালাচ্ছেন, ব্যাটারির বদলে টিনের সঙ্গে কানেকশন লাগিয়ে রেডিও চালাচ্ছেন। কেও কেউ রান্নার জন্য বৈদ্যুতিক হিটারও ব্যবহার করছেন। ব্যাপারটা সাংঘাতিক। ভয়াবহ রকমের দুর্ঘটনা ও প্রাণহাণীর ঘটনা ঘটতে পারে। অবশ্য গ্রামবাসী জানালেন, সেরকম কোন দুর্ঘটনা এখনও ঘটেনি।
তবে টিনে হাত দিলে শক খেতে হচ্ছে। সে কারণে তারা সাবধানে থাকছেন। সত্যিই শক খেতে হয় কিনা- তা যাচাই করার জন্য মুকুল আহমেদ সাহস করে টিনে হাত দিয়ে দেখতে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে শক
খেয়ে তিনি ছিটকে পড়লেন। সবাই বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটাকে গ্রামবাসী যতো সহজভাবেই নিন না কেনÑ এটা রীতিমত ভয়ঙ্কর বিপদজনক।
অনেকগুলো অবস্থান আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম। সব জায়গায়ই দেখা গেল, বাড়িঘর থেকে বিদ্যুৎ লাইন অনেক উপরে। তারপরেও বিদ্যুতায়িত হচ্ছে টিনের ঘরগুলো।
ব্যাপারটা সংবাদ আকারে তুলে ধরতে আমরা শহরে এসেই লেখা শুরু করে দিলাম।
শুধু আমরাই নয়,
খবর অন্যদের দিয়ে দিলাম। তাঁরাও রিপোর্ট তৈরি করে পাঠালেন।
পরদিন বিবৃতি ছাড়াও সংবাদ, ইত্তেফাক, গণকণ্ঠ, কিষাণসহ বেশ কতগুলো সংবাদপত্রে ফলাও করে এ
খবর প্রকাশ হলো।
এনিয়ে হইচই পড়ে গেল। একদিন পর
বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ঘটনার কারণ ও টেকনিক্যাল ব্যাখা দিয়ে বিজ্ঞপিও দিলো।
------- চলবে --------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message