রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
তিন.
সাংবাদিকতায় নামলাম কিন্তু এ সম্পর্কে কোন পড়াশুনা ছিল না। রাজনীতিতে থাকার কারণে রাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস ইত্যাদির উপর যে হাজারখানেক বইপত্র পড়াশুনা ছিল, তা দিয়েই কাজ চালাচ্ছিলাম। কিন্তু সাংবাদিকতার বিধিবদ্ধ রীতি-নীতি, সংবাদ লেখা বা গঠনের বিধান- এসব জানা ছিল না। এ সময় পর্যন্ত জানতাম না যে লেখা ‘সংবাদ’-এর ইন্ট্রো কতো শব্দের মধ্যে হতে হবে, সংবাদের গঠনপ্রণালী কি, ফিচার-প্রবন্ধ আর সংবাদ-এর মধ্যে পার্থক্য কোথায়। সাধারণ জ্ঞানে শুধু জানতাম অঘটনই সংবাদ, আর এটা লিখতে গেলে ‘কে কি কেন কবে কোথায় কীভাবে’- এইসব প্রশ্নের উত্তরগুলো থাকতে হবে। আমি এটাই অনুসরণ করছিলাম।
শিখতে হয় ‘পড়ে’ নয়তো ‘করে’।
আমি ছিলাম ‘করে’ শেখার পর্যায়ে। অবশ্য ‘করে’ শেখার উপরে কোন শেখা
যে নেই- সেটা আজও বুঝি। একজন পড়ে পড়ে যতোই শিখুন না কেন, কাজ করতে গেলে তিনি মোটেও পারবেন না। কিন্তু কাজ করে করে শেখা একজন তা
পারবেন সুন্দরভাবে।
কাজ শুরু করলাম। প্রতিদিন একটা-দুইটা করে সংবাদ পাঠাচ্ছিলাম। ছাপা হচ্ছিল চমৎকারভাবে। লেখার মধ্যে গুণগত মানও বাড়ছিল। যতো কাজ করছিলাম ততো শিখছিলাম। ফলে Practical কাজের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠছিল ‘অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি’।
তাছাড়া নিজের মধ্যে সব সময়ই একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হলো লেখার ভেতর দিয়ে মুক্তিকামী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে হবে। শ্রেণী-বৈষম্যের সমাজে এটাই সাংবাদিকতার আসল কথা বলে বিশ্বাস করতাম। ফলে নানা অঘটনের পাশাপাশি শোষণ-বঞ্চনা-লুণ্ঠন-নির্যাতন-দমন-পীড়ন এবং গণবিরোধী ঘটনার বিষয়গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। একটি সুন্দর-সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরির দিকে নজর রাখছিলাম। আসলে যে উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে নেমেছিলাম, সেই উদ্দেশ্যটাকে লেখনীর ভেতর দিয়ে বিকশিত করতে চাইছিলাম। এমনিতে আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। এই
কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে হবে- এমন বাসনা কখনই ছিল না। মানুষের ভালবাসা পাওয়ার একটা বিষয় ছিল। সেটা অবশ্যই মানুষের জন্য সত্যিকারের কাজ করার ভেতর দিয়ে চেয়েছিলাম।
তখন লেখা লিখতাম খুবই যত্ন করে। কোন কাটাকাটি বা ভুল থাকতে দিতাম না। প্রয়োজনে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখতাম। দীর্ঘ সময় ব্যয় করতাম একটা লেখা লিখতে। এমনিতে তখন হাতের লেখাও ছিল খুবই চমৎকার। গোটা গোটা অক্ষরে পরিস্কার পাতায় লিখে খামে ভরে পোস্ট করে আসতাম। এতেকরে পত্রিকায় আমার লেখা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে, বার্তা বিভাগকে একটা অক্ষরও কাটতে হতো না। আর
খবরগুলো ছাপা হচ্ছিল বেশ বড় বড় হেডিংয়ে গুরুত্বসহকারে। এই লেখার ভেতর দিয়ে দৈনিক গণকণ্ঠে আমার পদবী ‘মফঃস্বল সংবাদদতা’ থেকে
‘নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা’ হলো। তারপর হলো ‘পাবনা জেলা প্রতিনিধি’। এক পর্যায়ে গোটা উত্তরবঙ্গের সংবাদও লিখতে লাগলাম। এরমধ্যে একদিন দলীয় সফরে পাবনা এসেছিলেন সম্পাদক মির্জা সুলতান রাজা। বনমালী ইনস্টিটিউটের ভরা সমাবেশে তিনি আমার সম্পর্কে বলেছিলেন, দৈনিক গণকণ্ঠে দেশের মধ্যে যে
তিন/চারজন সবচেয়ে ভাল সাংবাদিকতা করছেন, তারমধ্যে আমিও একজন।
আমাকে পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য করে নেওয়া হয়েছিল। ছোট হওয়ার কারণে ক্লাবের সবাই আমাকে খুব ভালবাসছিলেন। এইসঙ্গে খ্যাতিমান সাংবাদিকদের সঙ্গে মিশতে মিশতে সাংবাদিকতার খুঁটিনাটিও শিখে ফেলছিলাম। বিশেষ করে অধ্যাপক শিবজিত নাগ, এডভোকেট রণেশ মৈত্র, আনোয়ারুল হক, মির্জা শামসুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার বাসু, রবিউল ইসলাম রবি, আবদুল মতীন খানের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।
আমাদের সাংবাদিকতা চলছিল খুব আনন্দময় ভাবে। আমরা কয়েকজন একসঙ্গে দল
ধরে বিভিন্ন অফিস-প্রতিষ্ঠানে যেতাম। সেখানে কাজ-কর্মের তথ্য নিতাম। কোন অভিযোগ থাকলে তা ক্রসকানেকশন করে যাচাই করতাম। তারপর পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিতাম। সেগুলো ছাপা হচ্ছিল বেশ গুরুত্বসহকারে। এইদিক থেকে আমার গণকণ্ঠ, রবি ভাইয়ের সংবাদ, মতীন ভাইয়ে কিষাণ এবং পরে বাংলার বাণী সবচেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছিল। কারণ এই
সংবাদপত্রগুলো তখন আমাদের স্টাইলে পাঠানো প্রতিবেদনগুলোকে পছন্দ করছিল। আমরা যে শুধু দল
বেধে সাংবাদিকতা করতাম, তাই-ই নয়। আমরা পত্রিকার পলিসি অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে প্রতিবেদনও লিখছিলাম। বিশেষ করে সিনিয়র সাংবাদিকদের এটা বেশি করতে হতো। কারণ দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, অবজারভার, টাইমস ইত্যাদি সংবাদপত্রগুলো ছোচ ছোট ঘটনার সংবাদগুলোকে গ্রহণ করতো। গণকণ্ঠ’র
মতো বড় বড় আইটেম লেখার সুযোগ এগুলোতে ছিল কম। --------- চলবে ----------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message