রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
নয়টানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে দারুণ ফল মিললো। সামরিক জান্তা ও সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুতই তৈরি হয়ে গেল গণজোয়ার। মানুষ রাস্তায় নেমে পড়লেন। বাধ্য হয়ে পিছু হটলো জান্তা সরকারসহ তার সহযোগিরা। এইসঙ্গে গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠলো। পাবনার সঙ্গে সারাদেশ হলো একাট্টা।
এমন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পাবনায় নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যে ভূমিকা পালন করেছে- তা সারাদেশের মধ্যে ছিল বিরল। রাজনৈতিক দলগুলো যখন গাঢাকা দেওয়া অবস্থায়, রুখে দাঁড়াবার কেউ নেই- তখন সাংস্কৃতিক কর্মীরা সামরিক জান্তার জারি করা জরুরি আইন ভঙ্গ করেছে। রাজপথ কাঁপিয়েছে একটানা। যদিও এ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে নেতাকর্মীদের। কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা হয়েছে। তিনজন সংগঠককে জেলেও যেতে হয়েছে। কিন্তু বিজয় ঠেকানো যায়নি। এক পর্যায়ে সফল হয় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান। বিজয়ের পর আপাত কাজ শেষ হয়। আমার জন্য আবার সাংবাদিকতায় ফিরে যাওয়া জরুরি হয়ে ওঠে। ঠিক এরকম একটি সময়েই নতুন ঘটনা ঘটলো।
সাঁথিয়ার সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেন। তিনি একাধারে বিচক্ষণ, অনুসন্ধানী এবং বেশ সচেতন সাংবাদিক। নানা কারণেই তিনি ছিলেন সুপরিচিত। পাবনাতে তাঁরসঙ্গে সবচেয়ে বেশি খাতির ছিল শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আবদুল মতীন খানের। সাঁথিয়া থেকে পাবনা শহরে এলে তিনি মতীন ভাইয়ের বাড়িতেই রাত কাটাতেন। প্রেসক্লাব এবং সাংবাদিক মহলের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক। নতুন সংবাদপত্র বের করার ব্যাপারে তিনি প্রথমে আলোচনা করেন মতীন ভাইয়ের সঙ্গে। তারপর আমাকে নিয়ে বসেন। বসার মধ্যদিয়ে সংবাদপত্রটির নাম, এর প্রকাশক-সম্পাদক এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালনকারীদের নাম চূড়ান্ত করা হয়। প্রকাশক হিসেবে থাকেন হাবিবুর রহমান স্বপন নিজেই। সম্পাদক হিসেবে নাম আসে মতীন ভাইয়ের। কিন্তু তিনি সরকারি চাকরি করেন বলে আপত্তি তোলেন। তখন আমার নামটি চূড়ান্ত হয়। এভাবেই আমাকে 'সাপ্তাহিক পাবনা’ নামের সংবাদপত্রটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
কিন্তু খুব দ্রুত সময়েই সংবাদপত্রটি চালানোর জন্য খরচ সংকুলান কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটা অফিস নেওয়া হয় নিউ মার্কেট গেটের সামনে। অল্প-স্বল্প আসাবাবপত্র নিয়ে বসার ব্যবস্থা হয়। অল্প কয়েকজনকে নিয়ে শুরু হয় পত্রিকার কাজও। ছাপার জন্য নিজস্ব কোন প্রেস ছিল না। ফলে বিভিন্ন প্রেসে ধর্ণা দেওয়ার ঝামেলা পোহাতে হচ্ছিল। এর মধ্যদিয়েই আমরা রিপোর্টিং, সংম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়সহ সমুদয় লেখালেখির কাজ চালাতে থাকি। আমাদের মধ্যে মূল কাজের লোক হলাম আমি ছাড়াও, মতীন ভাই, স্বপন ভাই, সুশীল তরফদার প্রমুখ। এক পর্যায়ে ঠিক হলো, ছাপার কাজটা বগুড়া থেকে করার। সে অনুযায়ী এরপর শুরু হলো ম্যাটার নিয়ে বগুড়া যাতায়াত। এ কাজটা আমাকেই করতে হচ্ছিল। তবে প্রতি সপ্তাহে এভাবে কাজ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো টাকা-পয়সার। প্রথম প্রথম বগুড়ার মুকুল প্রেস, প্রবীণ সাংবাদিক জাহেদুর রহমান যাদু, হাসিবুর রহমান বিলু খুব সহযোগিতা করছিলেন। কিন্তু টাকা-পয়সার অভাবে নানা সমস্যা তৈরি হলো। শেষ পর্যন্ত পত্রিকা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে উঠলো। যদিও পাবনাতে খুব দ্রুতই সাপ্তাহিক পাবনার সার্কুলেশন বেড়ে গিয়েছিল। মানুষের মধ্যে দারুণ চাহিদা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বিবৃতির মত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এক সময় এর নিয়মিত প্রকাশনাই বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য তখন জীবনধারণ খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল। কোন আয়ের উৎস ছিল না। সাপ্তাহিক পাবনার সম্পাদক হলেও কোন বেতন-সম্মানী ছিল না। এক কথায় সবাই আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছিলাম। আমি অবশ্য কয়েকটি প্রাইভেট পড়াতাম। তাই দিয়ে কোন রকমে থাকা-খাওয়া চালাতাম। কিন্তু এক সময় অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যে, আর টেকা সম্ভব নয়। তখন বাধ্য হয়ে অন্য কোথাও চাকরির চিন্তা করতে হলো। শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী আমার বিষয়টা জানতেন। তিনি সবসময় খোঁজখবর নিতেন। আমার অবস্থা জেনে তিনি চাকরির জন্য জোর চেষ্টা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে বগুড়া যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। তার আগে চাকরির ব্যাপারে সেখানকার মুহম্মদ মাহবুব উল আলম টোকন ভাইয়ের সম্পাদিত 'দৈনিক উত্তরবর্তা’র সঙ্গে কথা বললেন। টোকন ভাই আমার মতই লোহানী ভাইয়ের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। লোহানী ভাই বলা মাত্র তিনি আমাকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নেওয়ার জন্য ডাকলেন। অবশ্য তখনও আমি যোগ দেবো কি দেবো না- দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভূগছিলাম। এ অবস্থায় একদিন আমাদেরই সহযোদ্ধা আবদুল জব্বার ভাই আমাকে জোর করে ধরে বগুড়া নিয়ে গেলেন এবং দৈনিক উত্তরবার্তায় দেখা করিয়ে সেখানে যুক্ত করে দিলেন। জব্বার ভাই দৈনিক উত্তরবার্তার পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন। পরে জেনেছিলাম, সম্পাদক টোকন ভাইয়ের নির্দেশেই তিনি আমাকে বগুড়ায় ধরে নিয়ে তাঁরসঙ্গে দেখা করান। এভাবেই ঘটলো পাবনা থেকে বগুড়ার সংবাদপত্রে যুক্ত হবার ঘটনা। উত্তরবার্তায় যোগ দিয়ে নতুন এক জীবন ফিরে পেলাম। সম্পাদক টোকন ভাই আমার ব্যাপারে একান্তই আপনজনের মত ভূমিকা রাখছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি লোহানী ভাইকে কতোখানি মান্য করেন। এই সংবাদপত্রটির অফিস ছিল শহরের মূল সাতমাথার কাছাকাছি কবি নজরুল ইসলাম সড়কে। একটা তিনতলা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে অফিস। উপর তলায় বসেন সম্পাদক মাহবুব উল আলম টোকন। দ্বিতীয় তলায় রিপোর্টিং, এডিটিং, বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য বিভাগ। আমার বসার জায়গা হলো দ্বিতীয় তলায়। এখানে বসেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক (যিনি সম্পর্কে সম্পাদকের খালু) মুহম্মদ আবদুল মতীন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ তিনি। তিনিই টোকন ভাইকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন। সবমিলিয়ে আমারাও তাঁকে মতীন খালু বলে সম্বোধন করতাম।
এখানে আমার সঙ্গী হন খালুর ছেলে আশিষ উর রহমান শুভ, প্রদীপ ভট্টাচার্য্য শঙ্কর, আখতারুজ্জামান আখতার, হাসিবুর রহমান বিলু, সম্পাদকের ছোট ভাই মাহমুদুল আলম নয়ন, আবু বক্কর সিদ্দিক, ফটো সাংবাদিক শফিউল আজম কমল প্রমুখ। বিজ্ঞাপন এবং সার্কুলেশনের মুল দায়িত্বে ছিলেন বাদশা ভাই বলে সম্পাদকের পছন্দের একজন। সঙ্গে ছিলেন আবদুল হামিদ ও ফয়েজ আহমদ।
এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, আমাকে খুবই আন্তরিকভাবে নিয়েছিলেন উত্তরাবর্তার সবাই। পরে বগুড়ার সব সাংবাদিকই আমাকে একান্তই নিজের করে নিয়েছিলেন। যে কারণে কখনও কোনদিন আমার কাছে মনে হয়নি- এটা আমার জন্মস্থান নয়। বলা যায়, পাবনার চাইতেও সম্মান পাচ্ছিলাম এখানে। আর আমিও বগুড়াকে গ্রহণ করেছিলাম আরেকটি জন্মভূমি হিসেবে। প্রথম দিকে টোকন ভাই আমাকে থাকার জন্য 'অন্নপূর্ণা’ নামে বিখ্যাত একটি হোটেলে রুম ঠিক করে দিয়েছিলেন। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর বাড়ি থেকেই। পরে অবশ্য আমি নিজেই সবার সহযোগিতায় ম্যাচ সিস্টেমে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। আমি যখন উত্তরবার্তায় যোগ দেই তখন বেতন ছিল ২,২০০ টাকা। একা চলার জন্য এটা অবশ্য যথেষ্ট ছিল। এটা ছিল ১৯৯০-পরবর্তী সময়ের কথা। বগুড়ায় কাজ করতে এসে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম। টানা সামরিক জান্তা আর মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের শাসনে পদপিষ্ঠ থাকার কারণে এখানকার কোন সংবাদপত্রই রাজাকার-আলবদর শব্দগুলো ব্যবহার করতো না। এমনকি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসেও ওই চক্রের নাম উচ্চারণ করা হতো না। 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ও লেখা হতো না। লেখা হতো 'দখলদার বাহিনী’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হয়েছে। দৈনিক উত্তরবার্তায়ও ছিল একই দশা। আমি দেখলাম, এমন ধারা পাল্টানো দরকার।
এ অবস্থায় কোন জাতীয় দিবসের (বিজয় দিবস না স্বাধীনতা দিবস খেয়াল নেই) নিউজ লেখার দায়িত্বটি আমাকে দিয়েছিলেন সম্পাদক টোকন ভাই। আমি লেখার সময় স্পষ্টতই উল্লেখ করলাম 'রাজাকার’ 'আলবদর’ এবং 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ শব্দ। নিউজ দেখে আমার সঙ্গের অনেকেই চোখ কপালে তুলনেন। বির বির করে বললেন, এই শব্দগুলো বোধহয় ছাপানো যাবে না। যাইহোক, লেখাটি সম্পাদকের কাছে চূড়ান্তকরণের জন্য গেল। টোকন ভাই আমাকে খুবই প্রাধান্য দিতেন, বিশেষ করে লোহানী ভাইয়ের কারণে। তিনি আমার কোন লেখাই কাটতেন না। তিনি নিউজটি পড়ার সময় ওই শব্দগুলোর জায়গায় গিয়ে থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বিরবির করে বললেন, বগুড়া রাজাকার-আলবদরদের ঘাঁটি এলাকা। এখানে জামায়াতে ইসলামের প্রভাব খুবই বেশি। তারপরেও আর কতদিন এদের ছাড় দেওয়া যায়! আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি যখন লিখেছেন, তখন থাকুক। দেখা যাক কী ফল হয়? তিনি আর নিউজিটির কোথাও কাটলেন না। বগুড়ায় দীর্ঘ সময়ের পর এই প্রথম দৈনিক উত্তরবার্তায় জাতীয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাসের কথাগুলো ছাপা হলো। এ নিয়ে সবাই একটু আতঙ্কে থাকলেও তেমন কোন উচ্চবাচ্য হলো না। এরপর এভাবেই ইতিহাসের কথা লেখা শুরু হলো। দৈনিক করতোয়ায়ও আস্তে আস্তে 'রাজাকার’ 'আলবদর’ এবং 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী’ শব্দগুলো আসতে শুরু করলো।
বগুড়ায় এসময় দুটি সংবাদপত্রই সবচেয়ে বেশি চলছিল। একটি দৈনিক উত্তরবার্তা, আরেকটি দৈনিক করতোয়া। শ্রদ্ধেয় দুর্গাদাস মুখার্জীর দৈনিক উত্তরাঞ্চলের প্রকাশনা তখন বন্ধ ছিল।
------ চলবে ------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message