ছবিতে বাম থেকে সঙ্গীত শিল্পী ও নাট্যাভিনেতা সাজ্জাদ হোসেন, লেখক আবুল হোসেন খোকন, কামাল লোহানী, গণসঙ্গীত শিল্পী গৌতম বাকালী ও সায়মা আক্তার মায়া। |
গণশিল্পীর কামাল লোহানী
- আবুল হোসেন খোকন
টানা নয় মাস বাংলাদেশ চষে বেড়ানোর পর টিমটা এলো পাবনায়। তাঁদের চাওয়া এমন একটি সমাজ- যেখানে শোষণ থাকবে না, জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ বলে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। উঁচু-নিচু বলে, কিংবা ধনী-গরিব বলে কোন বৈষম্য হবে না। সব মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জীবন-যাপন করবে। সমাজটা হবে শুধু মানুষের জন্য। কোন অন্যায়-অবিচার-দুঃখকষ্ট সেখানে থাকবে না। এমন একটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যে বিপ্লবের প্রয়োজন, সেই ক্ষেত্র গড়ার হাতিয়ার তৈরি করতেই টিমটা ঘুরছিল।
মাসটা ছিল অক্টোবরের মাঝমাঝি। পাবনার অত্যান্ত প্রভাবশালী সংবাদপত্র সাপ্তাহিক বিবৃতির কার্যালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছিল। বৈঠকের শিরোমনি ছিল আগত টিম। যার নেতৃত্বে ছিলেন কামাল লোহানী। যিনি তখন বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা এবং খ্যাতিমান সাংবাদিক। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের পরিচালকও তিনি।
বিবৃতির বৈঠক থেকেই পাবনার তরুণরা বিপ্লবের ক্ষেত্র গড়ার দিক নির্দেশনা পেয়েছিল। এ বৈঠকে কামাল লোহানী তুলে ধরেন বাঙালি জাতির হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। তুলে ধরেন সংগ্রামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য। আরও তুলে ধরেছিলেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ এবং দুঃশাসনের নানা বিষয়গুলো। বাঙালি জাতি কেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ করলো, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করলো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীসহ তাদের ধর্মান্ধ সহযোগিদের বিরুদ্ধে কেন দাঁড়িয়েছিল, কোন্ লক্ষ্য অর্জনে তারা যুদ্ধ করেছিল, আর দেশ স্বাধীন হবার পর কী ফল পাওয়া গেছে, কেন পাওয়া গেছেÑ ইত্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। তুলে ধরেছিলেন নানা ষড়যন্ত্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার দিক, পরিণতি হিসেবে আজকের বাস্তবতার কথা। সব শেষে তিনি মার্কসীয় দর্শনের আলোকে পরিস্কার করে দেন, একটি গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল-শোষণমুক্ত, তথা মেহনতি জনগণের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে অবিরাম যে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রয়োজন, সেটা ছিল না বলেই আজকের এই বিপর্যয়। বিপ্লব সফল করতে হলে সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ অপরিহার্য। এর ভেতর দিয়েই কেবল শ্রেণি সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের ক্ষেত্র গড়ে উঠে। কিন্তু সেই ক্ষেত্র গড়া হয়নি বলে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয়ে নিয়ে যাওয়া যায়নি। তিনি পরিস্কার করে দেনÑ সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে পুরনো ঘুনে ধরা রাষ্ট্র কাঠামোকে পাল্টানোর জন্য রাজনীতির যে ভুমিকা থাকা উচিতÑ তা থাকেনি। আর এ ভূমিকার জন্য যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা চাপ থাকা উচিত ছিল, তাও ছিল না। এক কথায় রাজনীতির মুল শক্তিভিত গড়ে তুলতে সাংস্কৃতিক লড়াই হয়নি, ফলে রাজনীতিও তার লক্ষ্যে যায়নি। আর রাজনীতি লক্ষ্যে না যাওয়ার কারণে আমাদের পুরনো শোষণবাদী ব্যবস্থাপনাও পাল্টানো যায়নি। সুতরাং আজ এই পাল্টানোর কাজটাই জরুরি। বিপ্লবের প্রয়োজনেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে বিপ্ল¬বের ক্ষেত্র রচনা করতে। পারে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সেই পথে নিয়ে যেতে। সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষেই মানুষের বিপ্লবী চেতনাকে মনের ভেতর থেকে জাগ্রত করা সম্ভব। বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে এটা করা সম্ভব, যা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। সুতরাং এরকম একটি বিপ্ল¬বী সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্ম দিতেই এ বৈঠকের আয়োজন।
কামাল লোহানী বলেন, তাঁরা এ লক্ষ্য নিয়েই ঢাকা থেকে এসেছেন। এভাবে সারা দেশে তারা সফর করে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলছেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লবের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চান।
এটা ছিল প্রায় ৩৯ বছর আগের কথা। তখন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী প্রবীণ হলেও মনে-প্রাণে ছিলেন তরুণ। আর সেই তারুণ্যেই তিনি দেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন। গড়ে তুলছিলেন গণমানুষের গণশিল্পীদের সংগঠন। পাবনার বৈঠক থেকে আমরাও সবাই সেদিন থেকে গণশিল্পী হয়ে যাই।
গড়ে তুলি বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা। এরপর দিন গড়িয়েছে, বেড়েছে সংগঠনের বিস্তৃতি, সারাদেশে দাঁড়িয়ে গেছে গণশিল্পীর লড়াকু দল। এই দলে যুক্ত হয়েছেন নামী-দামি ব্যক্তিবর্গ থেকে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা তরুণ-তরুণি।
লোহানী ভাই এবং তাঁর সঙ্গে থাকা টিমের ব্যাপক তৎপরতার ফল হিসেবে গণশিল্পীর নাম দেশব্যাপী মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক শাসন, ধর্ম ব্যবসায়ী চক্র এবং শোষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সকল রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশের সবখানে পরিচালিত হয় গণনাটক, গণসঙ্গীত, গণনৃত্যসহ সাংস্কৃতিক নানান কর্মযজ্ঞ।
যার কারণে একদিকে তৎকালীন সামরিক শাসক এবং তাদের সহযোগী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ভিত্তি নড়ে ওঠে। পাশাপাশি গণআন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক শক্তির অপোসকামীতা বা ঝিমিয়ে পড়ার প্রবণতাকেও রুখে দেয়া সম্ভব হয়। ফলে দেশে জন্ম নেয় গণঅভ্যুত্থানী প্রেক্ষাপট। এখানে নাট্য ও
সাংস্কৃতিক আরও যেসব সংগঠন, বিশেষ করে গণশিল্পী সংস্থার অবদান ছিল অনেকটাই বেশি। যদিও এই অবদান রাখতে গিয়ে গণশিল্পীর অনেকে অনেক রকম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
এমনকি পাবনায় শিল্পীরা সামরিক জান্তার জরুরি অবস্থা ভ-ুল করে জেলে পর্যন্ত গেছেন। লোহানী ভাইসহ শীর্ষ নেতারাও শিকার হয়েছেন অবর্ণনীয় জুলম-নির্যাতনের। চাকরি-বাকরির উপর পর্যন্ত নেমে এসেছে খড়গ। সুতরাং যাঁরা এমন সব প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবেলা করে একটি মহান ব্রত নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা চীর স্মরণীয়।
তাঁদের কখনও ভুলে যাবার নয়।
একটা ছোট শহর থেকে হলেও লোহানী ভাইয়ের বলিষ্ঠতা, একনিষ্ঠতা এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নেতৃত্বের সান্নিধ্য পেয়েছি অতি আপনজনের চেয়েও আপনভাবে।
কতদিন তাঁর বাসায় গিয়েছি, সময় কাটিয়েছি, তাঁর সঙ্গে এখানে-ওখানে গিয়েছি- তার হিসেব নেই। এই সান্নিধ্য থেকেই দেখেছি কী অসীম সংকল্প! দেখেছি লোহানী ভাইয়ের দেশ এবং মানবপ্রেম। একটি শুভ-শান্তির সমাজ গড়ার কী
গভীর মমতাময় প্রত্যয়।
গণশিল্পী গড়ার শুরুটা আমার পাবনা থেকেই।
এখান থেকেই লোহানী ভাইয়ের নেতৃত্বে চলেছি। ঠিক আমারমত সারা দেশের গণশিল্পীও চলেছে। আমি পাবনা থেকে চলার কথাটাই টানছি।
লোহানী ভাই ঢাকা থেকে নিয়মিত দিকনির্দেশনা দিতেন। প্রয়োজন হলে আমাকে ঢাকা যেতে হতো। এই যাতায়াতের ঘটনাগুলোও লোহানী ভাইকে জানার জন্য অনেক কিছু। এগুলোর বলে শেষ করার নয়। সংক্ষেপে আমি গণশিল্পীর জন্য তাঁর কর্মযজ্ঞের কিছু তুলে ধরছি। আমাদের গণসঙ্গীত টিমের প্রধান শ্যামল দাস জটিল ব্যাধীতে ভূগছিলেন। তিনি ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হলেন।
লোহানী ভাই-ই
সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্যামল দাসের সেবাযতেœর জন্য আরও একজনকে ঢাকায় থাকার প্রয়োজন।
সে জন্য তার ছোট ভাই উত্তম দাস ছিলেন। তিনিও পাবনা সঙ্গীত টিমের শীর্ষ একজন।
উত্তম কোথায় থাকবে- সেটা নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু সে সমস্যা থাকেনি। লোহানী ভাই তাকে নিজের বাসায় নিজের পরিবারের সদস্যের মত
করে থাকতে দিলেন।
এখানে না বললেই নয়, শ্যামল-উত্তমরা ছিলেন হরিজন সম্প্রদায়ের। তারা পাবনাতে সুইপার কলোনিতেই থাকতেন। ফলে মানুষ তাঁদের অস্পৃশ্য মনে করতো।
কিন্তু গণশিল্পী তাঁদেরকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করছিল। আর লোহানী ভাই সেই মর্যাদা দিয়ে প্রমাণ করেন গণশিল্পী- গণশিল্পীই। এখানে ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত বলে কিছু নেই।
সবাই মানুষ এবং সবাই শিল্পী। উত্তম-শ্যামলকে ঢাকায় থাকতে হয়েছিল প্রায় মাসখানেক। আমার জেলে যাওয়ার ঘটনাটাও এখানে উল্লেখযোগ্য। আমি গ্রেফতার হবার পর
লোহানী ভাই এতোটাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন যে, অফিসের কাজকর্ম পাত্তা দিচ্ছিলেন না। তিনি পাবনায় ছুটে আসতে চাইছিলেন। কী কী করতে হবে- তা নিয়ে আমার আইনজীবীদের অস্থির করে ফেলছিলেন। কিন্তু আইনজীবীরা বলেছিলেন, তাঁরমত ব্যক্তিত্বের এখনই আসা ঠিক হবে না। হয়তো শিগগিরই জামিনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
তাই চিন্তার কিছু নেই। সত্যিই তাই হয়েছিল। এখানেও লোহানী ভাইয়ের দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা এবং সিরিয়াসনেসের বিষয়টি ফুটে ওঠে। পাবনাতে গণশিল্পীর যতোগুলো সম্মেলন হয়েছে বা বড় বড় অনুষ্ঠান হয়েছে- সবগুলোতে লোহানী ভাই থেকেছেন।
তাঁকে আমরা কারও বাড়িতে রাখতে চাইলে, থেকেছেন। কিন্তু তিনি পছন্দ করতেন হোটেলে থাকতে। কারণ বাড়িতে থাকলে একটু জড়োতা নিয়ে চলতে হয়। কিন্তু হোটেলে সেটা হয় না। সে কারণে হোটেলকে তিনি বেছে নিতেন। কিন্তু সেই লোহানী ভাই নিজে থেকেই একদিন আমার ছোট্ট জরাজীর্ণ ভাড়া বাসায় এসে হাজির হলেন। আমি তখন বগুড়ায়।
সেখানে একটি দৈনিকে কাজ করি। দুপুরে প্রচন্ড গরমের সময় লোহানী ভাই এসে হাজির।
তারপর তিনি একেবারে সাদামাটা টিউবয়েলের পানিতে স্নান করলেন। আমার স্ত্রী ইয়াসমিন হোসেন টিউবয়েল চেপে পানি তুলে দিচ্ছিল। গামছা-লুঙ্গি পড়ে খুব আয়েশ করে লোহানী ভাই যে স্নান করলেন, তা তাঁর হাবভাবেই বুঝতে পারছিলাম। তারপর মেঝেতে বসে গ্রামীণ পরিবেশে আমাদের সঙ্গে আহার করলেন। কী যে ভাল লাগছিল- তা বলে বোঝাবার নয়। পাবনা গণশিল্পীর যতোগুলো প্রকাশনা হয়েছে, তার সবগুলোই লোহানী ভাইয়ের সাহায্যে হয়েছে। এই সহযোগিতায় তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিউটকে কাজে লাগিয়েছেন, ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেননের প্রেসকে ব্যবহার করেছেন।
ম্যাগাজিনের ডিজাইন, স্ক্যান, ট্রেসিং ইত্যাদি যতো আধুনিক যন্ত্রপাতির কাজ ছিল, সেগুলো পিআইবি থেকে করেছেন। ছাপার কাজটা হতো মেনন ভাইয়ের সুদীপ্ত প্রেসে। সেখানে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে লোহানী ভাই কাজ দেখে দিতেন। প্রকাশনা কাজের জন্য বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হতো।
সেটাও ঢাকা থেকে জোগার করে দিতেন লোহানী ভাই। এগুলির ডিজাইন বা
বিল নিয়ে আসার জন্য লোহানী ভাই আমাকে পাঠাতেন। আবার বড় বড় মানুষের লেখা সংগ্রহ বা তাঁদেরকে পাবনার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যও তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। ফলে আমি নিজেও পরিচিত হয়েছি সেইসব মানুষে সঙ্গে। যেমন কবি শামসুর রাহমানের লেখা নেওয়ার জন্য তার বাসায় যেতে হয়েছে কয়েকবার।
দৈনিক বাংলা অফিসেও যেতে হয়েছে। তিনি ম্যাগাজিনের জন্য কবিতা লিখেছিলেন। কবিতা হাতে দিয়ে তিনি আবার আসতে বলতেন প্রুফ দেখানোর জন্য। যতোবার প্রুফ দেখাতে নিয়ে যেতাম ততোবার তিনি সংশোধন করে নতুন প্রুফ দেখানোর জন্য আসতে বলতেন।
শেষে লোহানী ভাইকে বিষয়টা জানালাম। তিনি বললেন, আমি যতোবার যাবো তিনি ততোবারই সংশোধন করবেন।
তাই আর যাবার দরকার নেই।
শেষ যেটা দেখে দিয়েছেন সেটাই ছেপে ফেলো। আবার অভিনেতা মমতাজ উদ্দিনের সঙ্গেও কয়েবার দেখা করতে হয়েছে তাঁর বাসায় এবং জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে। তিনি পাবনার অনুষ্ঠানে এই যোগাযোগের কারণেই গিয়েছিলেন। নৃত্য গুরু আমানুল হকের বাসায় দিনে পর দিন যেতে হয়েছে। তিনি ম্যাগাজিনের জন্য লেখা তৈরি করছিলেন। আমাকে তাগাদা দিয়ে এটাকে শেষ করাতে হচ্ছিল। তিনি পাবনার অনুষ্ঠানে এসেছেন। আরও এসেছেন কবি আবু বক্কর সিদ্দিকও।
সাংগঠনিক খরচ চালাবার জন্য লোহানী ভাই কখনই নিজেদের মধ্যে ছাড়া কারও কাছ থেকে চাঁদা বা
টাকা উত্তোলনকে প্রশ্রয় দিতেন না। এনজিওর মোটা অংকের টাকা তো
নয়ই। তিনি সংগঠনের আদর্শ পরিপন্থী কোন গোষ্ঠী বা মহল থেকে অর্থ সংগ্রহের ঘোর বিরোধী ছিলেন। যে কারণে গোটা সংগঠনকে সব সময় দারুণ অর্থ সংকটে কাটাতে হয়েছে। এমনকি রাজধানীতে একটি কেন্দ্রীয় অফিস পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া কঠিন ছিল। আবার ভাড়া নিলেও তা বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি ভাড়া পরিশোধ করতে না পারার কারণে। এই বাস্তবতায় লোহানী ভাই নিজের বাসা বাড়িকেই অফিসঘর হিসেবে ব্যবহারের ঝামেলা সয়েছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন রিহার্সেল বা মহড়ার জন্য এটা ছিল বড় রকমের ঝামেলা। কিন্তু তিনি সব
সয়েও সংগঠনকে রক্ষা করেছেন। লোহানী ভাই যে
কতোখানি দেশপ্রেমিক ছিলেন এবং দেশ নিয়ে ভাবনার মানুষ ছিলেন- তার প্রমাণ পেয়েছিলাম তাঁর ঘুমের ঘোরের কথা থেকে।
পাবনায় সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে এসে লোহানী ভাইকে হোটেলে থাকতে হয়েছিল। দুই বেড়ের রুমে একটিতে তিনি এবং আরেকটিতে আমি ছিলাম।
গভীর রাতে হঠাৎ গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি লোহানী ভাই উত্তেজিতভাবে স্বপ্নের ভেতর কথা বলছেন। অনেকটা চিৎকার করে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছেন, মানুষের মুক্তির কথা বলছেন, অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে বাঁচাতে বলছেন।
গোঙানির ভাষায় এসব যখন বলছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, তিনি স্ট্রোক করতে পারেন।
তাড়াতাড়ি আমি গায়ে হাত দিয়ে তাঁকে জাগিয়ে তুলে মুখে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু এমন ঘটনা একবার নয়। রাতে কয়েকবার হয়েছিল। তাতে বুঝেছিলাম- এসব নিয়েই তিনি সব সময় দুঃচিন্তা করেন। রাতে ঘুমানোটা তার নির্বিঘœ হয় না। তিনি এমনই খাঁটি দেশপ্রেমিক। ভাবতে অবাক লাগে।
লোহানী ভাই শুধু আমার, বা আমার পরিবার-বন্ধু-বান্ধব এবং সহযোদ্ধা-সমমনাদেরই অতি আপনজন ছিলেন না, ছিলেন আমাদের সবার পথপ্রদর্শক। ছিলেন সুবিশাল বটবৃক্ষের ছায়া। তিনি ছিলেন আমাদের শেষ অবলম্বন। কিন্তু করোনা তাঁকেও কেড়ে নিয়েছে। আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে লোহানী ভাইয়ের চলে যাওয়া ছিল মাথার উপর থেকে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো।
এই মহামানুষটির সঙ্গে কতো স্মৃতি কতো গভীরতার সম্পর্ক- তা বলে শেষ করার নয়। তিনি আমাকে কেন যেন খুবই ভালবাসতেন, নিজের মানুষ হিসেবে সবসময় খোঁজ রাখতেন। এই খোঁজেরই অংশ হিসেবে খুব গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়, যখন তিনি পারিবারিক কঠোর নিরাপত্তা ও নজরদারিতে- তখন একদিন (৫ মে ২০২০) সন্ধ্যার পর ফোন করলেন। জানতাম তাঁর কথা বলা নিষেধ। তারপরও তাঁর ফোন পেয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম।
ফোন ধরতেই তিনি পারিবারিক সবরকম খোঁজ-খবর নিলেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর জানতে চাইলেন, আমি অফিসে কিনা।
বললাম, হ্যাঁ। তিনি জানতে চাইলেন, ‘তাহের (আমাদের যুগ্ম-সম্পাদক আবু তাহের ভাই) আছে’ কিনা। বললাম, আছেন। তিনি তাঁকে একটু ফোনটা দিতে বললেন।
শ্রদ্ধেয় তাহের ভাইও লোহানী ভাইয়ের খুবই পছন্দের মানুষ। তিনি অনেক সময়ই বলতেন, Ôতাহেরের মত মানুষ হয়না। খুবই ভাল মানুষ।
অত্যন্ত মিশুক এবং গাল্পিক। সবাইকে মজিয়ে রাখতে পারেন। অসাধারণ একজন মানুষ।’ তাহের ভাইও বলেন, Ôলোহানী ভাই আমার বস। সবার আগে তাঁর জন্য কিছু করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’ আমি ফোনটা তাহের ভাইকে দিলাম। তারপর তাঁরা অনেকক্ষণ কথা বললেন। জানিনা, পরে তাহের ভাইয়ের সঙ্গে লোহানী ভাইয়ের আর
কথা হয়েছিল কিনা।
না হয়ে থাকলে এটাই ছিল তাঁদের শেষ কথা। এরপর আমার সঙ্গে লোহানী ভাইয়ের আর
মাত্র একদিন কথা হয়েছিল। সেটাই ছিল শেষ। আমি বন্যা লোহানীর (লোহানী ভাইয়ের মেয়ে) নম্বরে ফোন করেছিলাম। তারিখটা ছিল ৫ জুন ২০২০ রাত পৌণে ১০টা।
তখন লোহানী ভাইয়ের অবস্থা আরও খারাপ।
করোনার ভয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।
তাঁর কথা বলা বারণ তো ছিলই, বলার সামর্থ্যও ছিল কম। রিং বাজতেই ফোন তুলেছিলেন বন্যা লোহানীর বদলে কামাল লোহানী ভাই। আমি বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, কারণ এটা ধারণা করতে পারিনি।
তাঁর এই ফোন ধরা সম্পর্কে পরে মন্তব্য করেছিল খুব কাছের প্রিয় মানুষ কমরেড বোন মায়া (সায়মা আক্তার মায়া)।
বলেছিল, ‘বন্যাদি অনেক সময় তার বাবাকে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলিয়ে ভাল রাখতে চেষ্টা করেন। সেই কারণেই হয়তো তিনি নাম দেখে বাবার হাতে ফোন দিয়েছেন।’ এ ঘটনার বেশ কিছুদিন পরেই ধরা পড়লো লোহানী ভাই করোনায় আক্রান্ত। লোহানী ভাইকে Ôভাই’ বলে সম্বোধন করতাম। আবার তাঁর মেয়ে বন্যাকে বলতাম Ôবন্যা আপা’ বা Ôবন্যা দি’। এ নিয়ে একদিন লোহানী ভাইয়ের বাসায় খাবার টেবিলে কথা উঠেছিল।
বন্যা দি আমাকে Ôভাই’ বলে ডাকতেই লোহানী ভাই চোখ বড় বড় করলেন। বললেন, Ôকী রে, আমিও ভাই, তুইও ভাই বলিস, কেমন কথা?’ বিব্রতকর অবস্থায় আমিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইঙ্গিত করে আস্তে আস্তে মুখ খুলেছিলাম, Ôতিনিও তো সকলের ভাই।
কারও চাচা, মামা, খালু, দাদা নন। সবার ভাই মুজিব ভাই। এরকম মানুষকে সবার জন্য ভাই হিসেবেই মানায়। লোহানী ভাইও তেমন।’ শুনে লোহানী ভাই মিটমিট হেঁসেছিলেন। আসলে সেইমত আমিও তাঁকে ভাই বলে ডাকতাম, বন্যাদিকেও আপা বা
দিদি বলি। অনেককে হারিয়ে আমরা কয়েকজনের পরিবার লোহানী ভাইয়ের পরিবারে একপরিবার ছিলাম। গণশিল্পী সংস্থার সাঈদ ভাই (হ ম সাঈদ হোসেন), গৌতম বাকালী খোকন, সাজ্জাদ হোসেন, সায়মা আক্তার মায়া, রোকেয়া রুকু, মাহমুদুল হাসানসহ অনেকে।
আমরা কতোদিন যে
লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, গানের অনুষ্ঠান করেছি, গেটটুগেদার করেছি, বিভিন্ন দিবসে মিলিত হয়েছি- তার কোন হিসাব নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য- আমরা একসঙ্গে শেষ দেখাটার সুযোগ পেলাম না! বার বার দিন ঠিক করার চেষ্টা করেও সবার একইদিনে সুযোগ না
হওয়ায় পিছিয়ে গেছে মিলিত হবার দিন।
বন্যাদি আসতে বলেছেন, ডেকেছেন। কিন্তু সে
সুযোগ আর হলো না, কোনদিন হবে না। আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন আমাদেরই পুরোধা লোহানী ভাই। লাল সেলাম কমরেড লোহানী ভাই। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, মুক্তিকামী মানুষের পথচলায়, বাঙালি জাতির লড়াই-সংগ্রামে, বিশে^র
সব প্রগতিশীল আন্দোলনে।