রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
- আবুল হোসেন খোকন
কলাম লেখার শুরুটা ঘটেছিল প্রবন্ধ এবং সাহিত্য পাতার জন্য লেখার মধ্যদিয়ে। সেটা ছিল সত্তর দশকের শেষ দিক। তখন রাজশাহী থেকে বেরুতো জাতীয় দৈনিক ‘দৈনিক বার্তা’। সম্পাদক ছিলেন পথিকৃৎ সাংবাদিক কামাল লোহানী। আর আমার প্রবন্ধ এবং সাহিত্য পাতার জন্য লেখায় উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন শাহ আনিসুর রহমান। আগের কোনো লেখায় বলেছি- তাঁরা আমাকে কখনও দেখেননি। দেখলে লেখা নাও ছাপাতে পারতেন। কারণ আমার বয়স। ওই ছোট্ট বয়সে এসব বড় বড় লেখা আমিই লিখছি- সেটা হয়তো তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। আসলে ছোট বেলা থেকে বামপন্থী রাজনীতির তুখোর কর্মী এবং সেই সুবাদে মার্কসীয় দর্শনের উপর ব্যাপক পড়াশুনা- আমাকে জ্ঞানের দিক থেকে উন্নত করেছিল। তাছাড়া ওই বয়সে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার সময় দুই দফায় জেলেও যেতে হয়েছে (পরে আরেক দফা জেলে থাকতে হয়েছে সামরিক শাসক এরশাদের সময়)। যার ফলেই ভারি ভারি লেখাগুলো লিখতে পারছিলাম। আমি দৈনিক বার্তায় প্রবন্ধ আর সাহিত্য বিষয়ে লিখতে লিখতে কলাম লেখায় অগ্রসর হই। ঠিক ওইরকম সময়েই পাবনার নামকরা শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক শিবজিত নাগ সাপ্তাহিক বিবৃতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সংবাদপত্রে আমাকেও যুক্ত করেন। এরপর তিনি আমাকে কলাম লেখা, সম্পাদকীয় লেখাসহ বিভিন্ন লেখায় শুধু উৎসাহিতই করেননি, চাপ দিয়ে লিখতে বাধ্য করেছেন। সেগুলো ছাপা হয়েছে সাপ্তাহিক বিবৃতি ছাড়াও অনেক পত্রিকায়। তখন পত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। দৈনিকের চেয়ে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এবং সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সংখ্যা ছিল একটু বেশি। আমি যেগুলোতে লিখতাম সেগুলো ঢাকার।
এরপরে বিবৃতির সম্পাদক আমিও হয়েছি। আরও পরে আমার সম্পাদিত‘সাপ্তাহিক পাবনা’ বেরিয়েছে, পরে বগুড়া থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক উত্তরাঞ্চল’-এ যুক্ত হয়েছি। এসব জায়গায়ও আমার কলাম ছিল অন্যতম। আশির দশকে কলাম লেখার মূল ক্ষেত্র হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকার দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলো। নব্বইয়ের দশকে এসে তা আরও বিস্তৃত হয়। অবশ্য পুরো নব্বই দশক আমার কর্ম অবস্থান ছিল বগুড়া। সেখানে দৈনিক উত্তরবার্তা, সাপ্তাহিক শরণী, সাপ্তাহিক পূর্বালোক ছিল লেখার মূল জায়গা। এর বাইরে রাজধানী ঢাকার দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সমকালসহ আরও কয়েকটি দৈনিক এবং সাপ্তাহিক রোববারসহ অনেকগুলো সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে (এগুলোর বেশির ভাগেরই নাম মনে পড়ছে না, কারণ ম্যাগাজিনগুলো সংগ্রহেও রাখতে পারিনি) নিয়মিত কলাম লিখেছি। প্রখ্যাত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার সম্পাদিত দৈনিক মাতৃভূমি এবং তারপরে তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর নিয়মিত কলাম লেখক ছিলাম। বগুড়া ছেড়ে ঢাকায় আসার পর খুশী কবির পরিচালিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘নিজেরা করি’ এবং বিশিষ্ট লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বাধীন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। সেখানে থেকেও কলাম লেখার কাজগুলো চালিয়ে গেছি নিয়মিত। এই লেখালেখির কারণে তথাকথিত এক-এগারোর সময় দেশে-বিদেশে একরকম খ্যাতনামা কলাম লেখক হিসেবেও পরিচিতি এসে গিয়েছিল। কারণ ওই সময় শাসকগোষ্ঠীর দালাল শ্রেণীর লেখক ছাড়া আর কারও টিকে থাকা কঠিন ছিল। টিকতে হলে গোঁয়ারের মত লড়তে হতো। ফলে সব কাগজগুলোতে একদল সুবিধাভোগী বিশেষ শ্রেণীর লোক ছাড়া আর সবাই প্রায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারা জীবন-জীবিকার ভয়ে এ পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হন। ফলে তখন অদৃশ্য সামরিক শাসকদের কঠোর সমালোচনা করে লেখার মানুষ কমতে কমতে ৬/৭ জনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই ৬/৭ জনের একজন আমিও ছিলাম। তখন দেশের কাগজগুলোর মধ্যে দৈনিক আজকের কাগজ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ভোরের কাগজ এবং দৈনিক জনকণ্ঠ আমাদের কলামগুলো দুঃসাহস নিয়ে ছাপতো। এসময় আমার কলামগুলো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রকাশ হতে থাকে। এসব বিদেশি অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান ছিল ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, নিউইয়র্ক এবং জার্মানি। যে কলামগুলো দেশের কাগজগুলো ছাপার সাহস পাবে না- সেগুলো পাঠাতাম বিদেশে। তখন এসব কলামের প্রভাব এবং শক্তি এতোটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, এক-এগারো সরকারের অস্তিত্ব ধসের মুখে চলে আসে এবং সাদা পোশাকের বিশেষ লোকেরা আমাদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমার একটা লেখা ছাপার কদিন পরে তো দৈনিক আজকের কাগজ আকস্মিকভাবে বন্ধই হয়ে গেল। আমার একটা লেখার- কথা বলছি এজন্য যে, ওই লেখাটা ছাপতে পাঠিয়ে দিয়ে উপসম্পাদকীয় পাতার দয়িত্বে থাকা সালাম সালেহ উদদীন ফোন করে বলেন, ‘এতো ভয়ঙ্কর লেখা যে লেখেন, এখন আমাদেরই না ধরে নিয়ে যায়! কাগজও বন্ধ করে দিতে পারে। তারপরেও ছাপা হচ্ছে আপনার লেখা।’ সত্যিই, লেখা ছাপা হয়েছিল, তার ৩/৪দিন পরেই বন্ধ হয়ে গেল আজকের কাগজ। তবে এই লেখা, না- অন্য কোন কারণে আজকের কাগজ বন্ধ হয়ে যায়- তা আজও জানা হয়নি।
ভোরের কাগজেও প্রায় এরকম একটি ঘটনা ঘটে। একদিন রাত ১০টার দিকে ফোন করলেন উপসম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বে থাকা হারুন রশীদ ভাই। বললেন, ‘আপনার লেখা মেকাপ করে ছেড়ে দেওয়ার পর তুলে নিতে হচ্ছে। আপনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে যেভাবে সমালোচনা করেছেন- তা ছাপা সম্ভব নয়।’ আসলে উনি পেজমেকাপ করে প্রেসে পাঠানোর পর উপরের কেও চেক করতে গিয়ে বিষয়টি ধরেন এবং বিভাগীয় সম্পাদকের উপর চড়াও হন। তারপর প্রেস থেকে মেকাপ পরিবর্তন করা হয়। ঘটনা হলো, আমার লেখাগুলো বেশিরভাগ কাগজগুলোই চেক করতো না। তাঁরা আমার লেখা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতো। তাই কোনরকম চেক না করেই বিশ্বাস বা আস্থার উপর ভর করে ছেড়ে দিতো, এডিটিংয়ের প্রয়োজন হতো না। যদি এই লেখাটি এডিটিংয়ে দেওয়া হতো- তাহলে আগেই হয়তো বাতিল হতো। এতো ঝামেলার দরকার হতো না।
যাই হোক, কলাম লেখার জন্যই আশির দশক, নব্বইয়ের দশক এবং পরের দশকের একটা সময় পর্যন্ত ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলাম। সাংবাদিকতার জীবনে এটা ছিল আমার অনেক অনেক বড় পাওয়া। এরজন্য দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য প্রশংসা, চিঠি ইত্যাদি পেয়েছি। বগুড়ায় দৈনিক করতোয়ার মতো বহুল প্রচারিত দৈনিকের পাঠকরার ওই সময় আমার কলামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। সাংবাদিক হিসেবে এমন প্রশংসা সত্যিই নিজের জন্য গর্বের ছিল। কিন্তু এরমধ্যে আবার একটা বিপরীত দিকটাও ছিল। এটা কেউ কখনও বলেন না। কিন্তু আমি বলছি। একই পেশার অনেকজনই সহকর্মীর এরকম প্রশংসা পাওয়াকে ভালভাবে নিতে পারতেন না। এটা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ইগোতে মারাত্মকভাবে আঘাত করতো। তাই বলছি- শক্রপক্ষের শত্রæতায় দুঃখ থাকে না, কিন্তু নিজের ঘরে যখন এটা হয় তখন খুব কষ্ট পেতে হয়। এই কষ্ট থেকেও হয়তো আমাকে কলাম লেখা থেকে সরে আসায় খুব ধীরে হলেও ইন্ধন জুগিয়েছে।
আমার কলাম লেখাকে শুধু উৎসাহিত করেই যাঁরা ক্ষ্যান্ত হননি, চাপ প্রয়োগ করে লিখতে বাধ্য করেছেন- তাঁদের মধ্যে পাবনার প্রফেসর শিবজিত নাগ, প্রয়াত সাংবাদিক আনোয়ারুল হক, প্রয়াত সাংবাদিক আবদুস সাত্তার বাসু, প্রয়াত সাংবাদিক মির্জা শামসুল ইসলাম, প্রয়াত সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম, বগুড়ার প্রয়াত সাংবাদিক দুর্গাদাস মুখার্জী, প্রয়াত সাংবাদিক মুহ. আবদুল মতীন, মাহবুব উল আলম টোকন, প্রয়াত যাহেদুর রহমান যাদু, জাতীয় পর্যায়ে উপমহাদেশের পথিকৃৎ সাংবাদিক প্রয়াত কামাল লোহানী, প্রয়াত সংবাদ সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, পথিকৃৎ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ।
একটা পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং এক-এগারোর সরকার থেকে নির্যাতনের মুখে পড়েছি। তখন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নিজস্ব তহবিল থেকে বেশ ক’জন সাংবাদিককে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন, তারমধ্যে আমিও ছিলাম। তাঁর সেই সহায়তা তুলে দিয়েছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। এটা যেমন ছিল নিজের জন্য সাংবাদিকতার স্বীকৃতি, তেমন ছিল কঠিন বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ও।
যাক সেসব। লেখার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। বলছিলাম, সংবাদের আসার পর কেন বন্ধ হয়ে গেল কলাম লেখা। সেটা দিয়েই এ পর্বের ইতি। সংবাদে যখন আসিনি, তখন আমার কলামগুলো এক নম্বরে (অর্থাৎ সর্বপ্রথম উসম্পাদকীয় হিসেবে) এবং দুই নম্বরে ছাপা হতো। এর মানে হলো- আমার লেখাগুলোর মান-গুন শীর্ষে ছিল। কিন্তু যখন সংবাদের যুক্ত হলাম, তখন নিজেকে গুছিয়ে নিতে বেশ কতগুলো মাস সময় নিয়েছিলাম। এই সময়ে কোথাও কলাম লিখিনি। অফিসিয়ালি ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল, সংবাদ ছাড়া যেন আর কোথাও না লিখি। সে কারণে সংবাদেও কলাম বা উপসম্পাদকীয় লিখিনি, অন্য কোথাও নয়। তারপর এক সময় সংবাদের জন্য লিখলাম। জমা দিলাম। ছাপার জন্য পাঠানোও হলো। তারপর দেখি, ছাপা হয়নি। পরে সংশ্লিষ্টজনকে প্রশ্ন করলাম। তিনি জানালেন, মুনীর ভাই বাদ দিয়েছেন। মুনীর ভাইকে প্রশ্ন করলাম। তিনি স্পষ্ট করে উত্তর দিলেন না। বললেন, ‘আর কতো লিখবেন? কী হবে লিখে?........ ’
তাঁর এই কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি। পরে আরেকটি লেখা জমা দিলাম। সেটাও ছাপা হলো না। অথচ লেখা ছাপানোর জন্য অনুরোধ করে আমার কাছ পাঠানো অন্যের লেখা যখন জমা দিলাম, সেটা ঠিকই ছাপা হলো। বুঝতে পারলাম, আমার লেখা ছাপাতে চাওয়া হচ্ছে না। আগেই বলেছি, অনেক সময় ইগো কাজ করে। যেমন এটা দেখেছি করতোয়ার একজনের মধ্যে এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রধানের মধ্যে (অথচ এই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান অনেক আগে থেকেই আমার অগ্রজ শ্রদ্ধাভাজন, আজও তাই-ই)। ভাবলাম সমস্যাটা সংবাদেও। যখন মুনীর ভাইয়ের কাছে ছিলাম না, দূরে থেকে লেখা জমা দিতাম-তখন লেখার কদর ছিল। আর যেই না কাছে চলে এলাম- তখনই ইগোর কারণ হলাম।
সেই থেকে লেখা বন্ধ। আর লিখি না। কোথাও না। আর না লিখলে হারিয়ে যেতে হয়। আমি সেই থেকে হারিয়ে গেছি।
----- চলবে -----