পুঁজিবাদ শুধু ধনিক নয়
অতি গরিবেও ভর করে
- আবুল হোসেন খোকন
শিরোনামের সত্যতা বিশ্বের অনুন্নত বা গরীব দেশগুলোতে এখন জলজ্যান্ত। বাংলাদেশে একজন নুন আনতে পান্তা ফুরানো লোকও আরেকজনকে ঠকিয়ে নিজে লাভবান হওয়ার চিন্তা করেন। কারণ তার মগজ জুড়ে স্থান করে নিয়েছে লুণ্ঠনের মানসিকতা। রাষ্ট্র, সমাজ এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনা যখন এই মনোবৃত্তিকে লালন করে, উন্মাদনা জোগায় এবং এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতায় কোন রকম ভূমিকা না রাখে- তখন সবকিছুতেই পচন ধরে, সবকিছুই নষ্টের সাগরে নিমজ্জিত হয়। এখানে সেটাই হয়েছে। আর এটাই হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার সার্থক রূপ। সাম্রাজ্যবাদের সাফল্যটা এখানেই।
পুঁজিবাদ আসলে কি? তা কি শুধু শোষণের মাধ্যমে ধন-সম্পদের দিক থেকেই একটি শ্রেণীকে উপর থেকে আরও উপরে তোলে? না, তা কিন্তু নয়। কারণ, পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর মূল চরিত্রকে সর্বস্তরে প্রথিত করতে হয়। সেই চরিত্রটা হল, এমন এক মন-মানসিকতা বা চিন্তা-চেতনা কিংবা মনোবাঞ্ছা প্রতিষ্ঠিত করতে পারা- যা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অপরকে (সে যেই হোক না কেন) ঠকাতে, বঞ্ছনা করতে, প্রতারিত করতে, জবরদস্তি করতে মরিয়া থাকে। এর বাইরেও প্রয়োজনীয় সব কৌশলেরই প্রয়োগ ঘটায়। এই মানসিকতায় কোন দয়া-মায়া থাকে না, থাকে না মানবতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি কোন কিছুই। থাকে না- এমন অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোন রকম প্রতিজ্ঞা, অঙ্গীকার, বা সংগঠিত হওয়ার লক্ষ্য। এখানে থাকে শুধু ঠকানো আর ভোগ করা, ভোগ করা আর ঠকানোর চিন্তা।
আর এটাকে স্বাভাবিক করতে পারাটাই হলো পুঁজিবাদ এবং এর পৃষ্ঠাপোষক সাম্রাজ্যবাদের সফলতা।
এই চরিত্র আজ শুধু ধনিক গোষ্ঠীর মধ্যেই নয়, এটা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দোদর্- প্রতাপের সঙ্গে অবস্থান করছে।
যে কারণে আজ
শুধু ধনিক শ্রেণী বা তাদের শোষণ, শাসন, লুণ্ঠনকে দোষারোপ করলে চলবে না। এ দোষটা এখন ঘরে ঘরে, মগজে মগজে, মানুষে মানুষে। কারণ সবাই বুঝে গেছেন সৎ থেকে, ভাল থেকে, মানুষের মত মানুষ থেকে কোন লাভ নেই। পশুত্বই এখন টিকে থাকার একমাত্র উপায়। টিকে থাকার লড়াইয়ে ধনিক শ্রেণীতে উন্নীত হওয়া না যাক, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়ে কোন রকমে বেঁচে থাকা তো যেতে পারে! আর বাঁচতে পারলে ভাগ্য তো উপরের দিকেও নিয়ে যেতে পারে! অন্তত না খেয়ে, না পড়ে- মরে যেতে তো হবে না। এই ভাবনাটাই হলো আজকের বাস্তবতা।
অনুন্নত, গরীব বা অভাবী অন্য দেশগুলোর মতই বাংলাদেশের গরীবরাও বিশেষ এই চারিত্রিক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। যে চরিত্র প্রয়োজনে মুখে ভাল মানুষীর ভান করে, বিশেষ করে ধর্মকে 'জীবনের সর্বশেষ্ঠ’ বিষয় উল্লেখ করে মসজিদ, মন্দির, গীর্জাসহ ধর্ম উপাসনালয়গুলো হুমরি খেয়ে পড়ায়। কিন্তু ধর্মের যে ভাল ভাল কথা, কাজ রয়েছে- সেগুলোর কোনটাই ব্যক্তি জীবনে প্রতিফলিত হয় না। এটা হলো পুঁজিবাদী- সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের অন্যমত দিক।
লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবো- আমাদের দেশের ৯০
ভাগের বেশি মানুষ মুসলমান ধর্মে বিশ্বাসী। এই ৯০ ভাগের আবার অধের্কের বেশি মানুষ ধর্মের নামে জীবন উৎসর্গ করতেও দৃশ্যত প্রস্তুত। কিন্তু সত্যিই যদি তারা ধর্মে বিশ্বাসী হন, ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করেন- তাহলে তো এই মুসলমানের দেশে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচার, অনিয়ম, ব্যাভিচার, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া, সুযোগ পেলেই এক লাফে নিত্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে লাভবান হওয়া, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা, মানুষের ক্ষতি করাসহ তাবৎ খারাপ কাজগুলো করতেন না। এমন পাপ করার প্রশ্নই উঠতো না। এই দেশ, এই সমাজ জীবন হয়ে ওঠার কথা ছিল বেহেস্তখানার মত। কিন্তু কই? তা তো হয়নি! তাহলে কীসের মুসলমান? কীসের ধর্মপ্রাণ? কীসের ভাল মানুষ?
অনিময়, অন্যায়গুলো কিন্তু আমরা এখন অতি সাধারণ মানুষরা বড় মাপে করছি। এটা শুধু ধনিক শ্রেণী করছে না, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা গরীব বা অতি গরীবরাও করছি। করছি এই যুক্তিতে যে, আমরা শোষিত, বঞ্চিত, গরীব, দরিদ্র। আসলে এইসব খোড়া যুক্তি আর বিশ্বাসের অস্তিত গড়ার ভেতর দিয়েই পুঁজিবাদ- সাম্রাজ্যবাদ আমাদের মগজ থেকে শুরু করে দেহের অনু-পরমানুতে পুঁজিবাদ- সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র ভর করিয়ে দিয়েছে। অজান্তেই আমাদের কব্জা করে ফেলেছে মহাশত্রু। ফলে আমরা এর অনুগত বা দাসে পরিণত হয়েছি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, অনুগত বা দাস হয়ে কি আসলেই আমরা লাভবান হতে পারছি? নাকি কখনও পারবো? না, পারবো না। বরং এই
ভরের নিচে থেকে আমরা কেবলই শত্রুকে ঘাড়ে করে রাখবো। তাদেরকে দীর্ঘজীবী করার সুযোগ দেবো। কারণ হিসাবের কথা, সমাজ বিজ্ঞানের কথা, ইতিহাসের কথা কিন্তু এটাই বলে।
আমরা আমাদের নিঃস্ব এবং ধ্বংস করে দেওয়া পক্ষকে দেহের উপর চারও করে রেখে কখনই উপরে উঠতে পারবো না। এ ক্ষেত্রে একটাই পথ,
সেটা হলো- জোটবদ্ধ হওয়া। একাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়ানো। মনে রাখতে হবে, ধর্মের নামে ভন্ডামি করে, লোভের সাগরে ঝাপ দিয়ে, নিজেকে মানুষের বদলে পশুতে পরিণত করে ভাগ্য ফেরাতে পারবো না। বরং এতেকরে ভাগ্য যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকবে। আমাদের কেবলই ধ্বংস আর ধ্বংস হতে হবে। সুতরাং আজ
ভাবতে হবে- আমরা ধ্বংস চাই, না বাঁচতে চাই।