সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রহস্য




রাশিয়া-ইউক্রেন

যুদ্ধের রহস্য

- আবুল হোসেন খোকন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বয়স এক বছরে পা দিতে চলেছে এই যুদ্ধে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু জয়-পরাজয়ের খবর নেই পরাশক্তি পর্যায়ের দেশ রাশিয়াও দুর্বল ইউক্রেনকে পরাজিত করতে পারেনি, আবার তাবৎ পশ্চিমা শক্তির সমর্থন এবং সামরিক সাজ-সরঞ্জাম পেয়েও রাশিয়ার কিছু করতে পারেনি ইউক্রেন অর্থাৎ এক ধরণের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে; তাতে মানুষ মরছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের মহোৎসব চলছে কিন্তু কারও জয়-পরাজয় ঘটছে না আর এই রহস্যময় মহোৎসব চলছে মাসের পর মাস ধরে বলার অপেক্ষা রাখে না- মহোৎসব আরও দীর্ঘ সময় চলতেই থাকবে

প্রশ্ন হলো- এরকম ঘটনার আসল রহস্য কি? এর জবাব একটা হতে পারে যে, ইউক্রেনের আশা ছিল পশ্চিমা সহায়তায় নিজের দেশ, অথবা অর্থ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট জেলোনস্কির নিজস্ব গোষ্ঠীর ব্যাপক উত্থান রচনা করা এইসঙ্গে আশা ছিল, পশ্চিমাদের খুশী করতে তাদের শত্রু রাশিয়ারও কবর রচনা করা

আমরা যদি এই জবাবের বিষয় খতিয়ে দেখি, তাহলে দেখা যাবে- দুই আশার কোন আশাই পূরণ হয়নি, হবার সম্ভাবনাও নেই বরং ইউক্রেন নামের দেশটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংসস্তুপ বা বিদ্ধস্ত হয়ে চলেছে এছাড়া পশ্চিমা অস্ত্র সহায়তার ফলে অর্থনৈতিক ঋণের পরিমাণও এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত দেশটি বিক্রি করে দিলেও শোধ করা যাবে না

এবার উপরের প্রশ্নের আরেকটি জবাব দেখা যাক এটা হতে পারে, রাশিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট জেলোনস্কি চাইছিলেন হিটলারের Ôনাৎসীজম কে চাঙা করার নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হিরো হবেন ইউক্রেন থেকে অন্য জাতি-গোষ্ঠিীকে হটিয়ে বা নির্মূল করে তিনি সর্বেসর্বা হয়ে উঠবেন

জবাবের বিশ্লেষণও বলবে- জেলোনস্কি হিরোও হতে পারেননি, সর্বেসর্বাও হতে পারেননি যুদ্ধে জয় অর্জন না হলে তো এটা হতে পারেও না যদিও তার পশ্চিমা বন্ধুরা প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে বা খেতাব দিয়ে তাকে হিরো বলে স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এর যে আসলে কোন মূল্যও নেই, অর্থও নেই- তা কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না সুতরাং এখানেও ফলাফল শূন্য

আর প্রশ্নের জবাব আরেকটা হতে পারে সেটা হলো, প্রেসিডেন্ট জেলোনস্কি চমক সৃষ্টি করে ইউক্রেনকে ন্যাটোভূক্ত দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যাতে করে পশ্চিমাদের আর্শিবাদে দেশকে বা নিজের গোষ্ঠীকে ধন্য করতে পারেন

দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে ফলাফল ষোলকলা পূর্ণ করতে পারেনি কারণ ন্যাটোভূক্ত করবো, করছি, করা হবে, এই করা হলো- ইত্যাদি বলে বলে যেভাবে সময় ক্ষেপণ করা হয়েছে এবং শেষমেষ নামকা ওয়াস্তে সদস্যভূক্ত করার খাতায় নাম তুলে যেভাবে Ôপ্রক্রিয়ার ফেরে ফেলা হয়েছে- তাতেকরে এখনও সব ঝুলে আছে আর আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ধন্য হওয়ার কাজটিও হাসিল হয়নি জেলোনস্কি হয়তো ভাবেননি, ন্যাটোভূক্ত হওয়ার কথাটায় রাশিয়া এমন চটে যাবে যে, সোজা সামরিক অভিযানই শুরু করে দেবে তিনি যা ভাবেননি, সেটাই হয়েছে যা থেকে এখন তাবৎ পশ্চিমা শক্তিকে যোগ করেও পার পাওয়া যাচ্ছে না বরং পশ্চিমারা কখনও Ôচালিয়ে যাও যুদ্ধ, আরও দেবো অস্ত্র আবার কখনও বলছে Ôরুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটা আপোস-রফা করো সবমিলে মহাবিপাক, মহা জটিলতা সেইসঙ্গে সময়ের পর সময় ফলাফল শূন্য গড়িয়ে যাওয়া যাকে বলা যেতে পারে Ôক্যাঁচকা কলে পড়ে  যাওয়া অবস্থা

তবে আর যাইহোক, এরকম জবাব আর প্রশ্ন যতোই থাক- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একটা ঘটনা বা রহস্য তো আছেই এর কিছু কিছু খোলাশা হওয়াও শুরু হয়েছে যেমন যুদ্ধের তো একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকবে সেটা যুদ্ধ জয় করেই অর্জন করা সম্ভব কিন্তু যেখানে জয়ও হচ্ছে না, পরাজয়ও হচ্ছে না, যুদ্ধ চলছেই, কাঁড়ি কাঁড়ি অস্ত্র খরচ হচ্ছে, মস্তিষ্কক্ষরণ হচ্ছে, গোটা বিশ্ব সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, সদরে-অন্দরে গণবিক্ষোভ তৈরি হচ্ছে অশান্ত হয়ে উঠছে গোটা পরিস্থিতি যদিও পশ্চিমাদের একটা লাভ হচ্ছে নিশ্চিত সেটা হলো জেলোনস্কির দেশকে দেনা বা ঋণের দায়ে জর্জরিত করে ফেলা হচ্ছে, পাশাপাশি নিজেদের অস্ত্র বিক্রি ব্যবসার রমরমা অবস্থা চলছে কিন্তু সবকিছু বিপর্যয়ের দিকে চলে গেলে ব্যবসার লাভ দিয়ে তো শেষ রক্ষা হবে না এটা যে- কেউ বোঝে না তা কিন্তু নয় তারপরেও যুদ্ধ চলছে, বিপর্যয় দোর্দন্ড প্রতাপে বাড়ছে

এই বাস্তবতায় একটা জিনিস কিন্তু পরিস্কার হয়ে গেছে সেটা হলো- যুদ্ধটা আসলে রাশিয়া-ইউক্রেন নামে চলছে বটে, প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে অন্য এক যুদ্ধ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভেতরে ভেতরে রুশ বলয় এবং মার্কিন বলয়ের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল জিজ্ঞাস্য হয়ে উঠেছিল, আগামীতে বিশ্ব কার কর্তৃত্বে চলবে? রুশ বলয়ে, নাকি মার্কিন বলয়ে? ব্যাপারে এতোদিন ধরে একক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্টের মনে হচ্ছিল, এই এককত্ব বুঝি হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে আর সময় গড়ালে জায়গাটা প্রতিপক্ষের হাতে চলে যেতে পারে কারণ পারমানবিক অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ রাশিয়া চীনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে উত্তর কোরিয়া, ইরান তাদের সমর্থনে রয়েছে আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো এইসঙ্গে রুশ বলয়ে নতুন প্রজন্মের সামরিক শক্তি দিনকে দিন কেবল বেড়েই চলেছে এভাবে চলতে থাকলে এমনিতেই মার্কিল বলয়ের পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে সুতরাং তাদের সামনে একটা প্রস্তুতির বিকল্প ছিল না প্রস্তুতি মানে, বুদ্ধি এবং সামরিক সক্ষমতার প্রমাণ যাচাই করা জরুরি হয়ে উঠেছিল আরও পরিস্কার করে বললে মানে দাঁড়ায়- প্রতিপক্ষকে রুখতে যুদ্ধশক্তির একটা রিহার্সেল করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু সেটার জন্য একটা স্টেজ বা মঞ্চ প্রয়োজন সেই মঞ্চে উভয় পক্ষ মহড়া চলাতে পারলে ভবিষ্যত যুদ্ধ এবং জয়-পরাজয়ের একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব

ঠিক একই ঘটনা রুশ বলয়ের জন্যও প্রযোজ্য তারাও একটা ধারণা পেতে চাইছিল যে- পারমানবিক যুদ্ধ, কিংবা বিশ্বযুদ্ধ হলে জয়-পরাজয়ের কী হতে পারে? এজন্য তাদের কাছেও একটা মঞ্চ এবং সেখানে উভয় পক্ষের মহড়ার প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে উঠেছিল অবস্থায় জিজ্ঞাস্য হয়ে উঠেছিল- মঞ্চ পাওয়া যাবে কোথায়, কোন্ দেশ মঞ্চ হতে পারে?

অবশেষ দেখা যাচ্ছে, এই মহড়া বা রিহার্সেলের জন্য মঞ্চ হিসেবে ইউক্রেন নামক দেশটিকে হাজির করেছেন ভলোদিমির জেলোনেস্কি আর তা লুফে নিয়ে মহড়া, রিহার্সেল বা শক্তিমত্তার সামর্থ্য যাচাই করছে দুই পক্ষ এই মহড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে মার্কিন বলয়ের সামরিক শক্তি আরেকদিকে রাশিয়া ব্যবহার করছে তার সামরিক শক্তি এভাবে যুদ্ধের আসল মহড়া চলছে রুশ বলয় এবং মার্কিন বলয়ের মধ্যে উভয় পক্ষই কৌশলী তারা কেউ কাউকেই প্রমাণ করতে চাইছে না যে, তারাই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী বা বিজয়ী কারণ বিজয়ী হওয়ার ঘটনা ঘটালে তো গোমর ফাঁক হয়ে যাবে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝে যাবে তার শক্তি বুদ্ধি মত্ত্বার ক্ষমতা, একইভাবে রাশিয়াও বুঝে যাবে তার ক্ষমতা কারণে কেউ বিজয়ীও হচ্ছে না, কেউ পরাজিতও হচ্ছে না কখনও কেউ ভান করছে- তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে এভাবে তারা অপরপক্ষের বুদ্ধি-মত্ত্বা যাচাই করতে চাইছে আরেক পক্ষও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেদের খোলাসা করছে না তারাও কখনও পিছুহটা, কখনও আগে বাড়া, আবার পিছু হটা কৌশল বজায় রেখেছে এভাবে যাচাই চলছে একে-অপরের শক্তি বুদ্ধির কিন্তু কেউ ধরা দিতে চাইছে না বলেই মহড়া থামছে না শেষ হচ্ছে না ইউক্রেন যুদ্ধ যতোক্ষণ না একে অপরে পরস্পরের বিষয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত না হবে- ততোক্ষণ পর্যন্ত এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা যে বন্ধ হবে- তা মনে হচ্ছে না প্রকৃতপক্ষে প্রায় এক বছরের কাছাকাছির এই মহড়ায় এখন পর্যন্ত কোন পক্ষই পরিস্কার হতে পারেনি যে, সত্যিকারে যুদ্ধ শুরু হলে কার জয় হবে, কার পরাজয় ঘটবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত হতে পারছে না যে, আগামী দিনে তার পক্ষে পরাশক্তি থাকা সম্ভব হবে কি, হবে না বিশ্বযুদ্ধ হলে তাদেরই জয় হবে কি, হবে না একই ব্যাপার আরেক পক্ষেও ফলে রহস্যময় ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই

 

1 টি মন্তব্য:

Thanks for Message