বাংলাদেশের ঘটনা
নিয়ে কিছু কথা
আবুল হোসেন খোকন
জুলাই ২০২৪-এর মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা কোন দেশপ্রেমিক মানুষেরই কাম্য ছিল না। কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন রক্তাক্ত বা ধ্বংসের পথে যাবে- তা কারও চিন্তায় ছিল না। আন্দোলনের নেতারাও দাবি করেন, তারা দেশে নারকীয় তান্ডব এবং ধ্বংসাত্মক ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। তা সত্ত্বেও দেশে ইতিহাসের ভয়াবহ অঘটন ঘটেছে। এসব ঘটনা কেন ঘটলো- তা নিয়ে ভাবতে হবে এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। খতিয়ে দেখা যাক ঘটনাগুলো-
১. কোটা সংস্কারে ছাত্র আন্দোলন ছিল অরাজনৈতিক। কিন্তু সেটা হঠাৎই রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে যায়। সরকার পতন আন্দোলন হয়ে যায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ভয়াবহ হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। তাতেকরে প্রাণ গেছে শত শত মানুষের। আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। আর সম্পদের যে ক্ষতি সাধন হয়েছে, তা দেশ ও জাতিকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেক বছর।
শান্তিপূর্ণ অরাজনৈতিক আন্দোলন হঠাৎ ধ্বংসাত্মক ও রাজনৈতিক হয়ে ওঠার দায় কার? পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের জন্যই-বা কে বা কারা দায়ী? শুরুতে সরকার থেকে কঠোর কিছু কথা বলা হলেও পরে ইতিবাচক সমাধানের আশ্বাস দিয়ে ছাত্রদের আদালতের রায়ের জন্য মাত্র কদিন অপেক্ষা করতে বলা হয়। তা সত্ত্বেও সেই অপেক্ষাটুকু করা হয়নি। ফলেই ঘটেছে যতো অঘটন। এরজন্য দায় কি শুধ্ইু সরকারের? কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব কি এ দায় কোনভাবে এড়াতে পারেন? এর জবাব নিয়ে ভাবতে হবে।
২. ক্ষমতাসিন দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বলা যায় পরিস্থিতি সামাল দিতে কাউকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। নেতৃত্ব এটি বুঝতে পেরেই হয়তো দলীয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ব্যর্থ কমিটিগুলোকে।
এখানে বিচার্য বিষয় হলো, ইতিহাসের বিচারে আওয়ামী লীগ একটি মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দল। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রচনায় দলটি বাঙালি জাতির মাইল ফলক। মধ্যবিত্ত্ব এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষই দলটির মূল শক্তি। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দলটি সেই আদি অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি বলেই এখানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে রাজ্যের সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, ধান্ধাবাজ এবং ধর্মব্যবসায়ী-মৌলবাদী চেতনায় বিশ্বাসী লোকজনের। ক্ষমতা এবং লোভ-লালসাই এদের রাজনীতি হয়ে উঠেছে। এরকম হাইব্রিডদের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই জনস্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে দলটি আস্থা-বিশ্বাস হারিয়েছে। এমনকি পুরনো ও ত্যাগী সংগঠকদেরও নেতিবাচক অবস্থানে ঢেলে দিয়েছে। সুতরাং সময় এসেছে বিষয়গুলো আমলে নেওয়ার এবং ভাবনা-চিন্তার। পরিস্থিতিই আজ দলকে শিক্ষা গ্রহণের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
৩. সাধারণ মানুষ বা জনগণ নিয়েও কথা আছে। ‘হুজুগে বাঙালি’ বলে একটা প্রবাদ আছে। কারণ হুজুগে আমরা বেহুশ হয়ে যাই এবং স্রোতের জলে গা ভাসাই। ওই মুহূর্তে ভাল-মন্দ বিচারবোধও হারিয়ে ফেলে ভুল পথ মারিয়ে ফেলি। এই ঘটনা কিন্তু এবারও দেখা গেছে। ছাত্র আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে যখন দেশবিরোধী অপশক্তি মাতম শুরু করেছে, তখন দেখা গেছে আমাদের অনেকেই হুজুগে মাতাল হয়েছেন। কী ঘটানো হচ্ছে- সেটা তারাও বেমালুম ভুলে গেছেন। তাদের হুশ যখন ফিরেছে তখন যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। এই ক্ষতির শিকার এখন তাদেরই হতে হচ্ছে। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার এই হুজুগ থেকে বাঙালির মুক্ত হওয়া জরুরি। এসব নিয়েও ভাবতে হবে এবং ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
৪. নিজেদের নিয়ে ভাবনার বিষয় রয়েছে বিরোধী দল, তথা বিএনপি-জামায়াত-শিবিরেরও। আফগান স্টাইলে বিপ্লব করে খমতা দখল করার পন্থা এদেশের জন্য নয়। এটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। সুতরাং একটু এদিক-ওদিক দেখলেই হামলে পড়ার অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। এদেশে রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করতে হবে, গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মানুষের অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য দূর করার পথে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে এদেশের মানুষ সামরিক শাসন দেখেছে, আধা-সামরিক শাসন দেখেছে, স্বৈরশাসন দেখেছে, ধর্মভিত্তিক শাসনও দেখেছে। এগুলো কী দিয়েছে- তা মানুষ হাড়ে হাড়ে জানেন। মানুষ কিন্তু এগুলোর কোনটিকেই আর ফিরিয়ে আনতে চান না। তারা চান শান্তি, চান শৃঙ্খলা এবং চান সামনের দিকে এগিয়ে চলতে। এক অর্থে তাঁদের মূল প্রত্যাশা, যা আছে তাই নিয়েই সবাইকে মিলেমিশে দেশ ও জনগণের স্বার্থে একসঙ্গে চলা।
এমন অবস্থাকে সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াতের সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা আছে। একটি হলো, আবারও অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। আর একটা পথ হলো, অবৈধ পথ পরিত্যাগ করা এবং ভুল-ত্রুটি থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে দেশের মঙ্গলের পথে নামা। এটা করতে হলে নিজেদেরকে অমুল পাল্টাতে হবে। নতুন বোতলে পুরাতন মাদক ঢালার পরিবর্তে সত্যিকারভাবে দেশের মঙ্গলের কথা ভাবতে হবে, দলীয় স্বার্থকে পরিত্যাগ করে জনগণের স্বার্থকে গ্রহণ করতে হবে। এইসঙ্গে সরকারকেও নিশ্চিন্ত থাকতে দিতে হবে। ‘ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ ‘পতন ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে’- এসব চিন্তা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তাহলেই সবেমিলে একসঙ্গে দেশ ও দশের জন্য কাজ করার ক্ষেত্র রচনা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, একসঙ্গে কাজ করতে না পারলে (যে দলই ক্ষমতায় থাকুক সেই দলের) সুযোগ সন্ধানী স্বার্থবাদী লোকেরা অপকর্ম করবেই। সরকার, বিরোধী দলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে এরা দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদিতে ব্যস্ত সময় পাড় করবেই। সরকারের হাতে তখন এদেরকে মোকাবিলার সুযোগ থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু সবাই একসঙ্গে এক রাজনীতি নিয়ে চললে বাছাই করে এক-একটা অপকর্মকারীকে পাকড়াও করা সম্ভব। এরকম একটা প্রেক্ষাপট কিন্তু চাইলেই রচনা করা যায়। মানুষও একে ভূমিধস সমর্থন করবেন। তাই অকল্পনীয় হলেও এ নিয়ে ভাবা যেতেই পারে।
৫. চাকুরি ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্রদের মরণপণ ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাদের এই আন্দোলন থেকে মনে হয়েছে দেশ, মানুষের জীবন, দেশের সম্পদ- এগুলো কিছুই নয়, চাকরি কোটাই সব। তারা যেন চাকরিকোটা বা চাকরিজনিত সার্টিফিকেটের জন্যই পড়াশুনা করছে। যদি তাই-না হবে তাহলে তাদের মাধ্যমে শত শত মানুষের প্রাণহানী, হাজার হাজার মানুষের জীবন বিনষ্ট এবং রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ ও অর্জনকে ধ্বংস করার ঘটনা ঘটতো না। দেশপ্রেমিক হলে কখনই কেউ ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান তুলতে পারতো না। এই যদি মেধা হয়- তাহলে সেই মেধা কি কাম্য? এমন মেধারা হাতে ক্ষমতা পেলে, চাকরি পেলে দেশের কি পরিণতি হবে- তা কি ভাবা যায়?
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মেধা মানে মেধাই। সেটা অবশ্যই দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। মোটেও তা শুধু চাকরি জন্য নয়। বিষয়টি সবারই ভেবে দেখে সংঘটিত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
৬. তথাকথিত আন্দোলনের সময় টার্গেটে ছিল রাষ্ট্রীয় সম্পদ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা, প্রচার সংস্থা, অফিস-প্রতিষ্ঠান-শিল্প-কারখানা-ব্যাংক-বীমা এবং দেশের তাক লাগালো উন্নয়ন স্থাপনাসমূহ। এগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস অথবা অকার্যকর করা হয়েছে। এটা কারা করতে পারে এবং কারা এটা চাইতে পারে? এটা চাইতে পারে তারাই- যারা বাংলাদেশের অগ্রগতি-উন্নয়ন সহ্য করতে পারছে না, যারা বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখতে চায়, পায়ের নিচে রাখতে চায়। এটা চায় কোন কোন আন্তর্জাতিক পরাশক্তি চক্র। আর এজন্য তারা এদেশের কোন কোন মহলে নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ সরবরাহ করে থাকে। তাদেরকে ব্যবহার করেই ওই শক্তি আমাদের সমস্ত অর্জন-অগ্রগতি ও উন্নয়নকে ধ্বংস করতে চায়। গেল মাসের ঘটনার মধ্যদিয়ে আমরা সেটা আরও একবার পরিস্কার করে দেখেছি। সুতরাং ‘হইতে সাবধান’।
৭. সবশেষে সেনাবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাধুবাদ জানাতে হয়। অনেক ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিয়ে তারা সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশকে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রেখেছেন। মানুষকে আবার স্বস্তি আর শান্তির মুখ দেখিয়েছেন। এরজন্য অনেক অনেক সাধুবাদ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message