মাকিদ হায়দার এবং
হায়দার পরিবার
-আবুল হোসেন খোকন
তাঁর সঙ্গে পরিচয়টা অন্যভাবে হয়েছিল। বেশ ক’বছর আগের কথা। হঠাৎ আমার কর্মস্থলে তিনি হাজির। এখানকার শীর্ষরা আগে থেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ। আমিই কেবল এলাকার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সাক্ষাৎ পরিচিত ছিলাম না। তিনি যখন হাজির হলেন তখন পথিকৃৎ সাংবাদিক আবু তাহের ভাই আমাদের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখিয়ে যখন বললেন, ‘ইনি আপনার পাবনার মানুষ’। শুনেই রসিকতা শুরু করলেন মাকিদ ভাই। বললেন, 'ও, নকশাল’? এটা বললেন, কারণ একটা সময় ‘নকশালদের’ দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল পাবনায়। তার উপর আমার জন্মস্থান একেবারে নকশালদের ঘাঁটিতে, মানে রাধানগরে। এই রাধানগরেই এডওয়ার্ড কলেজ। আর এ কলেজ ছিল সাতষট্টি-আটষট্টি-উনসত্তর-সত্তরে নকশালদের ঘাঁটি। আমাদের রাধানগর জুড়ে ছিল তার বিস্তৃতি। আরেকটা কথা হলো, এই এডওয়ার্ড কলেজেরই ছাত্র ছিলেন কিংবদন্তি নকশাল নেতা চারু মজুমদার। রাধানগর জুড়ে ছিল তাঁর এবং নকশাল নেতা টিপু বিশ্বাসদের বিচরণ। স্বাভাবিকভাবেই পাবনার বাইরে থাকা মানুষদের অনেকে ওই সময়ের কথা স্মরণ করে ‘নকশাল এলাকার মানুষ’ বলে পাবনাবাসীকে উল্লেখ করেন। রশিদ হায়দার ভাইও তাই করলেন।
আমি তখন আমতা আমতা করে বললাম, ‘না, আমি নকশাল নই। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আপনার ছোট ভাই তপন হায়দার।’ উনি তখন আরেক ধাপ রসিকতা করে বসলেন, 'ও! তারমানে জাসদ, গণবাহিনী?’ আমি 'থ’। তাঁর এমন বলার কারণ, স্বাধীনতার পর জাসদ-গণবাহিনীরও দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল পাবনায়। হায়দার পরিবারের বসতি আরিফপুর দোহারপাড়া (গোরস্তান পাড়া) মহল্লায়, এ মহল্লা ছিল জাসদের ঘাঁটি। তপন হায়দার জাসদ রাজনীতি করতেন। এ কারণেই তাঁর এই মন্তব্য।
যাই হোক- তারপরে মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল, যেন সাত জন্মের সম্পর্ক। পরদিন ছিল আমাদের সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিতেই মাকিদ ভাই এসেছেন। সেখানেও সেদিন পথিকৃৎ সাংবাদিক তাহের ভাই, মাহমুদ ভাইসহ আমাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলায় পোঁচ দিলেন। গল্প করলেন, আড্ডা দিলেন। এমন আরও অনেক কিছু করলেন।
এই মানুষটির সঙ্গে এটাই ছিল আমার প্রথম এবং শেষ ঘনিষ্ঠভাবে মেশা। কারণ আমরা পাবনার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সময়ের ফেরে কে কোথায় চলে গেছি তার ঠিক-ঠিকানা নেই। পাবনায় এক সময় আমাদের যে রাজকীয় দাপট- সেটা আজকের কেউ-ই জানেন না। হায়দার পরিবারের ঘটনাও তাই-ই।
ছবিতে মাকিদ হায়দার জড়িয়ে ধরেছেন পথিকৃত সাংবাদিক আবু তাহের, মাহমুদ হাসান এবং লেখককে।
অনেকগুলো ভাইয়ের মধ্যে মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় না থাকলেও তপন হায়দারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে ছিল, আর ছিল রশিদ হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে। নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁরসঙ্গে মেলামেশাটাও কম হতো না। এটা ছিল তাঁরসঙ্গে প্রুশিকা থেকে নজরুল ইনস্টিটিউট পর্যন্ত। রশিদ ভাই আমার একাধিক বইয়ের মুখবন্ধও লিখেছেন। সে যাই হোক- রশিদ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতার আবার আলাদা ধরণ ছিল। তিনি জন্মভূমির কারও সঙ্গে কথা বললেই সাধু ভাষা বাদ দিতেন। শুরু করতেন ‘খাটি পাবনার ভাষায়’ বলা। সেই ভাষার ভেতর কী যে মাধুর্য পাওয়া যেতো- তা প্রকাশ করার নয়।
হায়দার পরিবারের পুরনো আদলের বিশাল জায়গা এবং বাড়িটি আমাদের কাছে তীর্থস্থানের মত। ওই বাড়িতে, ভবনে, কিংবা ভবনের ভেতর বিরাট পুকুর ঘাটে অনেক সময়ই আড্ডা দিয়েছি। করেছি রাজনীতি এবং সমাজ নিয়ে ভবিষ্যত চিন্তার নানা আলোচনা।
এই হায়দার পরিবার ইতিহাসের অংশ, বিশেষ করে পাবনার ইতিহাসে কিংবদন্তী। পরিবারের, অর্থাৎ রশিদ ভাই, মাকিদ ভাই বা তপন ভাইরা মিলে যতোগুলো ভাই আছেন- তাঁরা সবাই বিখ্যাত। সাহিত্য-সংস্কৃতি-নাটক এবং এই অঙ্গনের সবক্ষেত্রে তাঁরা আজ পর্যন্ত পাথেয়। এক নামে সবাই চেনেন মাকিদ হায়দারের ভাই রশীদ হায়দার, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার (তপন) ও আরিফ হায়দারসহ সাত ভাইকেই। সাত ভাইয়ের মধ্যে মাকিদ হায়দার ষষ্ঠ। সাত ভাইয়ের বোনও ছিল সাতজন। তাঁদের বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ ও মা রহিমা খাতুন।
পথিকৃৎ শিক্ষাবিদ প্রফেসর শিবজিত নাগ ও সাংবাদিক কামাল সিদ্দিকীকে জড়িয়ে ধরে মাকিদ হায়দার
তাঁদের সবার সঙ্গে পাবনার সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক্ষাবিদ এবং সংস্কৃতি সংগঠকদের ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। এক সময় পাবনার সাংবাদিক, তথা পাবনা প্রেসক্লাব এবং অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী পরিচালনাকরীদের সবাই ছিলেন ওই পরিবারের সঙ্গে একাত্ম। নাম ধরে কার কথা বলবো? এই মুহূর্তে সবার কথা মনেও পড়ছে না। আবার নিজের জানারও ঘাটতি কম নয়। তারপরেও বলা যায় ষাট, সত্তর ও আশির দশকের খ্যাতিমান সাংবাদিক রণেশ মৈত্র, আনোয়ারুল হক, মির্জা শামসুল ইসলাম, শিবজিত নাগ, রবিউল ইসলাম রবি, আবদুল মতীন খান, শিক্ষাবিদ মনোয়ার হোসেন জাহেদি, রাজনীতিক প্রসাদ রায়, আমিনুল ইসলাম বাদশা, ওয়াজিউদ্দিন খান, কবি ও লেখক আবু রইস, শফিকুল ইসলাম শিবলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল লী, শাকিব লোহানী, শামসুল আলম বকুল, শ্যামল দত্ত, শুচি সৈয়দ, মোসতাফা আরব সতেজ, আতাহার আলী, আমিরুল ইসলাম রাঙা, জাহাঙ্গীর আলম মুকুল, তোসলিম হাসান সুমন, সেলিনা খান শেলী, মালা মাহবুব, রুমি খোন্দকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুর রশিদ, সুলতান মুহাম্মদ রাজ্জাক, শাহনেওয়াজ খান স্বপন, মীরা রায়সহ অনেকে এই ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে অন্যতম।
মাকিদ ভাইদের হায়দার পরিবার শুধু স্বনামে সুপরিচিতই নয়, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে অনন্য ভুমিকার জন্য বটবৃক্ষসম। গোটা পরিবারই রাজনৈতিক সচেতন, দেশপ্রেমিক এবং প্রগতির চেতনায় শাণিত। এসব কারণে এই চেতনার মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তাঁদের।
এর আগে জাহিদ ভাই চলে গেছেন, রশিদ ভাই চলে গেছেন। এবার গেলেন মাকিদ ভাই। পাবনার জীবিত গৌরব থেকে খসে পড়েছেন হায়দার পরিবারের উজ্জ্বল তিন নক্ষত্র। মাকিদ ভাই আমাদের সম্প্রীতি বাংলাদেশ পরিবারেরও একজন। তাঁকে হারিয়ে আমরা আমাদের পরিবার থেকেও একজনকে হারালাম। শূন্য হলো জায়গাটি। যা কখনও পূরণ হবে না। তিনি এখন মাইল ফলক হিসেবে শুধু আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শিক্ষা-পথচলা এবং আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যে আলোকিত হয়ে থাকবেন। থাকবেন ভোরের সূর্য হয়ে, মাথার উপরে লুব্ধক হয়ে। প্রয়াত মাকিদ ভাইকে আমাদের সম্মিলিত গভীর শ্রদ্ধা।
হায়দার পরিবারের তিন কৃতিজন রশিদ হায়দার, জাহিদ হায়দার ও মাকিদ হায়দারের সঙ্গে গ্রন্থ লেখক আবদুল আলিম