তিনি আমাকে 'আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। অথচ আমি তাঁর থেকে অনেক ছোট, কিশোর। আমি তীব্র আপত্তি জানালে বলতেন, আপনি তো ব্যক্তি নন, আপনি একটা দলের প্রতিনিধি, মানে আপনি একটা দল। আর আমিও একটা দল। সুতরাং আমাদের সম্পর্ক দল- কে ভিত্তি করে। এখানে কেউ 'আপনি’ না বলে দলকে ছোট করতে পারি না। আমি সেটা করতে পারবো না।
এ ঘটনা ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯-এর কোন এক সময়ের। তখন শামসুজ্জামান সেলিম ভাই পাবনা জেলখানার সেলে থাকতেন। সারিবদ্ধ তিন/চারটি সেলের মধ্যে তিনি থাকতেন পশ্চিমের টায়, আমি পূবেরটায়। একজন একটা করে সেলে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময় আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম। তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন সিপিবি বা
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে। আমি গ্রেফতার হয়েছিলাম জাসদ বা
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সংগঠক হিসেবে। দু’জনেরই স্থান হয়েছিল পাবনা জেলখানার পূর্বপাশে জেলের ভেতর আরেক জেলখানায়, অর্থাৎ সেলে।
রাতের বেলা আমাদের সেলে আটকে রাখা হতো। দিনের বেলা দরজা খুলে দিলে সেলের গ-ির ভেতর হাঁটাচলা যেতো। তখনই আমাদের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা ও
বিতর্ক হতো। ওই
সময় জাসদ ও
সিপিবি উভয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও দুই দলের সম্পর্ক ছিল অনেকটা দা’কুমড়ার মতো। যদিও সেটা আমার বা
সেলিম ভাইয়ের বেলায় ছিল না। জেলখানার ডিভিশন কক্ষে থাকতেন কিংবদন্তিতুল্য কমিউনিস্ট নেতা কমরেড প্রসাদ রায়। তিনি সেলিম ভাইয়ে গুরু, আমারও অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার এবং গুরু মানুষ। এটা প্রথম সম্পর্কের সময়ের কথা। পরে সম্পর্কটা একেবারেই ঘনিষ্ট হয়ে উঠেছিল।
যাই হোক, জেলখানার ভেতরই প্রসাদ কাকা এবং সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এই সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে পাশাপাশি অনেক মাস কাটিয়েছি। তিনি তাঁর জীবনের অনেক কথা বলেছেন, আমিও বলেছি। সেলিম ভাই তাঁর কষ্টকর জীবনের যে
কথা বলেছেন, একটি তাঁর বিয়ের ঘটনা। এই বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান হয়নি। যে
প্রতিবেশী ও কমরেডরা এসেছিলেন তাঁদের আপ্যায়ন করা হয়েছিল টোস্ট বিস্কুট দিয়ে, কারণ এর বেশি সাধ্য ছিল না। কমিউনিস্টদের বিয়ে বলে কথা!
জেলখানায় আমরা রাজনীতি নিয়ে অনেক আলোচনা এবং বিচার বিশ্লেষণ করেছি। বলতে দ্বীধা নেই যে,
এই সেলিম ভাই-ই আমাকে নতুন ধারণায় বিকশিত করেছেন। এক ধরণের রক্ষণশীল অবস্থান থেকে বের করে এনেছেন। তিনি আমার চিন্তা-চেতনায় এনে দিয়েছিলেন বড় মাত্রায় পরিবর্তন।
জেলখানার অনেক স্মৃতি, অনেক কথা- যা এই স্বল্প পরিসরে বলার নয়। জেলখানা থেকে আমি একদিন মুক্তিলাভ করেছিলাম। দলীয় লোকেরা গণসম্বর্ধনার মত সম্বর্ধনা দিয়ে বিদায় জানিয়েছিল। অন্য কোন দল এ সম্বর্ধনায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছিল না। তবে প্রসাদ কাকা এবং শামসুজ্জামান সেলিম ভাই জেল গেট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধিত করেছিলেন। যেটি জাসদের কারও জন্য সিপিবি’র কারও করার কথা নয়।
অনেক পরে সেলিম ভাই এবং প্রসাদ কাকা জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তারপর আমার সঙ্গে প্রসাদ কাকার পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেলিম ভাই ঈশ্বরদী আর ঢাকায় থাকতেন বলে কম দেখা হতো। তবে জেলখানার সম্পর্কটি কোনদিন ভোলার নয়। সে এক গভীর, আন্তরিক, হৃদয়িক সম্পর্ক- যা কোন কিছুর সঙ্গেই তুলনা করার নয়।
সেই সেলিম ভাই চীরতরে চলে গেছেন- কথাটি ভাবতেই হতবিহ্বল হই। ভাবতে পারি না। কতো সহজ, সরল, আন্তরিক, নির্লোভ, সাধারণ মানুষের জন্য আজীবন আত্মত্যাগী-নিবেদিতপ্রাণ এক ব্যক্তিত্ব। যিনি সারা জীবন অর্থকষ্টে জীবনকে টেনে গেছেন শুধুমাত্র সমাজ বিপ্লবের জন্য। চাইলে তিনি অনেক কিছু পেতে পারতেন। কিন্তু কোন ব্যক্তি স্বার্থ, লোভ তাঁকে টানতে পারেনি। তিনি কেবলই নিজেকে বিলীন করে গেছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, একটা সুখী-সমৃদ্ধ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য। এমন মানুষ আজকের যুগে পাওয়া কঠিন এবং অকল্পনীয়। তাই সেলিম ভাইয়ের অভাব অপূরণীয়। তাঁর বিদায়ের মধ্যদিয়ে মুক্তিকামীদের হতে হলো নিঃসম্বল, নিঃস্ব। রাষ্ট্রও হারালো খাঁটি দেশপ্রেমককে।
লাল সালাম কমরেড সেলিম। আপনি অনাদিকাল বেঁচে থাকবেন মেহনতি মানুষের লড়াই এবং সংগ্রামে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Thanks for Message